‘হাতিরঝিলে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে দুর্গন্ধে পেট ফুলে যায়’
বসন্তের বিকেল। ফুলেল হাতিরঝিল। ঝিরঝিরে হাওয়া। অফিস থেকে ফেরার পথে খানিকটা হাঁফ ছাড়তে হাতিরঝিলে বসেছিলেন বনশ্রীর বাসিন্দা সর্বজয়া বিশ্বাস। প্রশান্তির বদলে হাওয়ায় ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই বলেন, “প্রকৃতির কাছে যাওয়া মানেই ‘বুক ভরে শ্বাস নেওয়া’। কিন্তু এ কেমন প্রকৃতি- যেখানে শ্বাস নেওয়ার বদলে দম বন্ধ করতে হয়। এর নাম বিনোদন কেন্দ্র!”
অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে শ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকুও নেই রাজধানীতে। সর্বজয়া বলেন, ‘বাসার কাছে এত সুন্দর জায়গা। অফিসেও যেতে হয় এই পথ দিয়ে। অথচ দুদণ্ড বসার পরিবেশ নেই। উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি মোটরবাইক নিয়ে অফিসে যাওয়া-আসা করি। হাতিরঝিলে এলেই বাইক থামিয়ে বসতে লোভ হয়। কিন্তু এত নোংরা পরিবেশ উপায় নেই। রোদ চড়া হলে ঝিলের পানির সঙ্গে মলমূত্রের গন্ধও বাতাস দূষিত করে তোলে। তখন বসা তো দূরের কথা এটুকু পথ দম বন্ধ করে পাড়ি দিতে হয়। অথচ হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় অনেক আধুনিক ব্যবস্থার কথা বলা ছিল।’
রাজধানীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিলের পানি অনেকটাই কমে এসেছে। একদিকে ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে, আরেক দিকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত চলাচলকারীদের। বিমুখ হচ্ছেন ঘুরতে আসা মানুষ। পানি পরিশোধনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই বলে অভিযোগ করলেন দর্শনার্থী ও আশপাশের বাসিন্দারা।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ- পয়োনিষ্কাশনের ময়লা-আবর্জনা ও নোংরা পানি ঢুকে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে হাতিরঝিলের পানি। বাতাস হলেও বের হয় উৎকট গন্ধ। চলাচলকারীদের অভিযোগ, এসব সমস্যা সমাধানের নেই কোনো যথাযথ উদ্যোগ। ঝিলে এখন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) ও শুক্রবার (৩ মার্চ) হাতিরঝিল ঘুরে দেখা যায়, পানি বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত। তবে ঝিলে যারা ওয়াটার-বাস বা বোটে চলাচল করেন তারা মূলত এই পানির দুর্গন্ধ বেশি বুঝতে পারেন।
নাগরিক জীবনে কিছুটা স্বস্তির জন্য মিরপুর থেকে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন রফিক হোসেন ও মেঘলা দম্পতি। তারা মগবাজার দাবার কোর্ট থেকে ওয়াটার বাসে চড়ে যান গুলশান পুলিশ প্লাজায়। ওয়াটার ট্যাক্সি থেকে নামার সময় তাদের কাপড় দিয়ে নাক চেপে ধরতে দেখা যায়। পানিপথের এই যাত্রার বিষয়ে জানতে চাইলে এই দম্পতি বলেন, ‘ঝিলের পানিতে ভয়ানক দুর্গন্ধ। বিকেলটাই মাটি।’
মাহাখালী থেকে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা দম্পতি লায়লা ও রাজিব বলেন, ‘ঝিলের ভেতরে আমরা কয়েকদিন আগে ওয়াটার বাসে গুলশান যাই। সেখানে যাওয়ার পথে বাতাসে পানির দুর্গন্ধে প্রায় আমাদের বমি হওয়ার ভাব হয়েছিল। আর ওয়াটার বাসে উঠব না বলে নিয়ত করেছি।’
হাতিরঝিলের দাবার কোর্ট থেকে ওয়াটার বাসে নিয়মিত গুলশানের যাত্রী মো. খালেদ বলেন, ঝিলের প্রায় সব অংশ থেকেই পচা পানির দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। রামপুরা ও মগবাজারের অংশের মধ্যে দুর্গন্ধ বেশি মনে হয়।
দেখা যায়, ঝিলের পানিতে ময়লা আর শ্যাওলার পুরু আস্তরণ জমে কোথাও নীলচে, আবার কোথাও কিছুটা সবুজ রং ধারণ করেছে। এই পানি জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ময়লা পানি মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়া এ নোংরা পানির স্পর্শে এসে আশেপাশের বস্তির শিশুরা নানা ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
হাতিরঝিল চক্রাকার বাসে রামপুরা থেকে মগবাজার এসেছেন নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে তো গাড়িতে ভালোই চলাচল করি কিন্তু হেঁটে যেতে হলে বা কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলে বাজে গন্ধে পেট ফুলে যায়।
এদিকে পুরো হাতিরঝিল ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ জায়গার পানি থেকে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সিটি করপোরেশনকে এই দূষণের উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে। ঝিলে যাতে সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় পানি শোধনের আধুনিক ব্যবস্থার কথা বলা ছিল সেটার অগ্রগতি কী সেটা জানতে হবে। তা ছাড়া আশেপাশের ময়লা ও নোংরা পানি এখানে প্রবেশের কথা ছিল না। আশেপাশের ময়লা ও নোংরা পানি ঝিলে প্রবেশ করে এর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ঝিলের পরিবেশ যাতে সব সময় ভালো থাকে সেই জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
এই পরিবেশবিদ আরও বলেন, ‘হাতিরঝিলের পানিতে অক্সিজেন ঠিক রাখতে এখন যে বুদবুদ দেখা যায় তাই যথেষ্ট নয়। আরও ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে লাইটিং অর্থাৎ চুনসহ অন্যান্য কেমিক্যাল দিতে হবে। তাহলেই পানি ভালো থাকবে মানুষ সুস্থ পরিবেশে ঘুরতে পারবে। বিশেষ করে শীত ও গরমের সময় যখন পানি কমে যায় তখন সেটা করলে ভালো হয়। লেকের আশেপাশে থাকা গাছের পাতা পানিতে পড়ছে। যা পচে গিয়ে এক ধরনের গ্যাস তৈরি হচ্ছে পানির নিচে। ফলে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
হাতিরঝিলের পানিতে প্রচুর গন্ধ, নেই শোধনে যথাযথ উদ্যোগ সাধারণ মানুষের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, ঠিক এই মৌসুমে ঋতুগত কিছু পরিবর্তন হয় এবং পানিতে হালকা গন্ধ হয়। ঝিলে নোংরা, অপরিষ্কার পানির বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি। সম্প্রতি ঢাকার খালগুলো আমরা পরিষ্কার করছি। খাল পরিষ্কারের মতো এটি করা যায় না। ঝিলের পানি পরিষ্কারের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেগুলোই আমরা নিচ্ছি।
কেএম/এসএন