জয়দেবপুর-এলেঙ্গা চার লেন সড়ক
শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ
কাজ শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। বেশ কয়েকবার সংশোধনীর পর আগামী জুনে শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে না। মির্জাপুরের গোড়াই ওভারপাসসহ বিভিন্ন স্থানে ধীরগতির পৃথক লেনের কাজ এখনও বাকি। তাই এবার পঞ্চম বারের সংশোধনীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হচ্ছে। পাঁচ বছরে পুরো কাজ শেষ করতে প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। সেই ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২১৪ কোটি টাকায়।
যেনতেন কোনো প্রকল্প নয়, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ‘জয়দেবপুর-এলেঙ্গা চার লেন সড়ক'র বাস্তব চিত্র হচ্ছে এটি। শুধু তা-ই নয়, অত্যন্ত ব্যস্ত এই সড়কের কিছু জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে রাখা হচ্ছে। যা যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
মির্জাপুরের গোড়াই এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ওভারপাসের র্যাম লাগানোসহ অন্যান্য কাজ চলছে। এ জন্য মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের পর থেকেই দীর্ঘ যানজট। সড়কের মাঝে ওভারপাসের কাজ চলমান থাকায় দুই দিকে ধীরে গতিতে গাড়ি চলছে। শফিপুরেও চলছে কাজ।
হানিফ বাসের চালক সোহেল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'নয় বছর ধরে এই সড়কের কাজ হচ্ছে। এখনো শেষ হচ্ছে না। গোড়াই বাজারে গাড়ির দীর্ঘ লাইন হয়। অনেক সময় চলে যায়। তবে যেখানে কাজ শেষ হয়েছে সেখানে দ্রুত গাড়ি চালানো যাচ্ছে।'
মির্জাপুরের জামুকি এবং সোহাগপুরেও 'ধীরগতির পৃথক লেন'র কাজ শেষ হয়নি। রোলার দিয়ে মাটি সমান করা হচ্ছে। আরও কিছু দিন সময় লাগবে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. ইসহাক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। ফিজিক্যালি অগ্রগতি ৯৯ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি একটু কম, তা ৮৬ শতাংশ। ঠিকাদারের বিল পরিশোধ বাকি থাকায় এ খ্যাতে অগ্রগতি একটু কম। মির্জাপুরের গোড়াই (হাটুভাঙ্গা), শফিপুর ও ঢাকা বাইপাস এলাকাসহ তিনটা ওভারপাসের কাজ চলমান। ঠিকাদারের সমস্যার কারণে গোড়াইতে একটু দেরি হচ্ছে।'
তবে জুন মাসেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই প্রকৌশলী।
তাহলে সংশোধন করে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কিছু এলাকায় জায়গা পেতে দেরি হওয়ায় অল্প স্থানে ধীরগতির পৃথক লেনের কাজে একটু দেরি হচ্ছে। এছাড়া সাতটি ফ্লাইওভার, দুইটি ওভারপাস ও ১১টি আন্ডারপাসে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে সব কিছু পরিচ্ছন্ন দেখা যায়। যা আগে ডিপিপিতে ছিলো না।'
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যস্ত এই সড়কের শফিপুর, চন্দ্রাসহ কয়েকটি এলাকায় গাড়ি পার্কিং করে রাখা হচ্ছে, গোবর রাখা হচ্ছে সেটা তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করতে সড়ক ও পরিবহন অধিদপ্তর থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলাপ্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে সেমিনার করা হবে। এই সড়কটি দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। চায়না থেকে হাইব্রিড ফুলের গাছ এনে আইল্যান্ডে লাগানো হয়েছে।'
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প: জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলঙ্গা সড়ক (এন-৪) চার লেন মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের নির্মাণ কাজ চলমান। যা ২০১৮ সালে শেষ করার কথা। কিন্তু নয় বছরেও শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৮৩ শতাংশ। বাস্তব অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ। তাই বাকি কাজ শেষ করতে পঞ্চমবারের মতো সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানা যায়, ঢাকা থেকে গাজীপুর-টাঙ্গাইল হয়ে মহাসড়কটি যাবে লালমনিরহাটের বুড়িমারী পর্যন্ত। আরেকটি মহাসড়ক যাবে দিনাজপুর হয়ে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত।
এই মহাসড়ক ধরেই বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটানে যাওয়া যাবে। তাই সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) সড়ক সংযোগ প্রকল্প: জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক (এন-৪) চার লেন মহাসড়কে উন্নীতকরণে উদ্যোগ নেয় সরকার। তাতে মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে বিদেশি ঋণ ১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করার কথা। ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের মার্চে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করার জন্য সরকার ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল অনুমোদন দেয়।
পরে ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ধরা হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি তা সংশোধন করে। তাতে সম্পূর্ণ কাজ হবে না উল্লেখ করে ২০১৬ সালের ২২ মার্চ আবার বিশেষ সংশোধন করা হয়। তাতে ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। চতুর্থবারের মতো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৫ হাজার ৫৯৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন নাগাদ করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ৮ মে ব্যয় ছাড়া সংশোধন করা হয়। তাতে প্রকল্পের মোট ব্যয় ৬ হাজার ২১৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের জুন ধরা হয়েছে। ফলে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকার প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে ৬ হাজার ২১৪ কোটি টাকা হয়েছে। এতে মূল প্রকল্প থেকে সংশোধিত প্রকল্পে অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা বেড়েছে।
জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা সড়কের কাজ হচ্ছে। কিন্তু শেষ হচ্ছে না। তাই এবার পঞ্চম বারের মতো সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে। তাতে সময় বাড়ানো হচ্ছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে গত ২২ আগষ্ট পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কিছু ব্যাপারে আপত্তি করা হয়। করোনার জন্য বিদেশি প্রশিক্ষণ বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় কমছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এভাবে ছোট কয়েকটি খাতে সামান্য ব্যয় কমেছে। তাতে মোট ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় কমে দাঁড়াচ্ছে ৬ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। তা পুনর্গঠন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)। সব প্রক্রিয়া শেষে একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে ৭০ কিলোমিটার চার লেন, ২ হাজার ৮০৯ মিটার সেতু নির্মাণ, যার মধ্যে ৫৩টি ব্রিজ রয়েছে। ৫ হাজার ১৬৫ মিটার ফ্লাইওভার ও ওভার পাস নির্মাণ। তাতে ১১টি আন্ডারপাস, ৭টি ফ্লাইওভার, ২টি রেলওয়ে ওভারপাস থাকবে। প্রকল্পের পুরো কাজ করতে প্রায় ৬৯ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ, প্রায় ৬০ লাখ ঘনমিটার মাটির কাজ। এছাড়া ৩১ হাজার ৮০ বর্গমিটারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটিতে ৩ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট এবং আবুধাবী ফান্ড ফর ডেভলপমেন্ট। এর সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। সে অনুযায়ী প্রকল্পের অ্যাপ্রাইজাল প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। তারপরও সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে বাজেটে ৯১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্প এলাকা হচ্ছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও কালিয়াকৈর। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, দেলদুয়ার, বাসাইল, টাঙ্গাইল সদর ও কালিহাতি। এছাড়া প্রধান কার্যালয় নির্মাণের জন্য ঢাকা জেলার তেজগাঁও ছিল প্রকল্পের আওতাভূক্ত এলাকা।
/এএস