‘সমন্বয়হীনতায়’ আটকে আছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন
নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে কোমর বেঁধে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারবিরোধী আরও বেশ কয়েকটি সমমনা রাজনৈতিক দল। যাদের সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করতে চায় বিএনপি। কিন্তু সঠিক সমন্বয়হীনতার কারণে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সঙ্গে পথচলা বা যুগপৎ আন্দোলন গতি পাচ্ছে না কিছুতেই। বরং বৈঠকের পর বৈঠকেই আটকে থাকছে এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলন।
একে অপরের প্রতি চাওয়া পাওয়ার বিষয়টিও আলোচনার টেবিলেই সীমাবদ্ধ। যদিও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, যুগপৎ আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপরেখা নিয়ে কাজ করছে দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটি। শিগগিরই এক দফা কর্মসূচিতে মাঠে নামবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী দলগুলো।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, বিএনপির ১০ দফা, গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফা, গণফোরামের ৮ দফা। এই সবগুলো মিলিয়ে আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপরেখা দেওয়া হবে। দফাগুলোকে সমন্বয় করে আন্দোলনে যেতে চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। যা মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হতে পারে।
এখন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গেও বিএনপির অনেকের ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে অনেকে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করতে আগ্রহী হয়েছে। তবে তারা আরও কিছুদিন সময় নিতে চাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে খুব একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না বিএনপি। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরাও চাচ্ছে বিএনপিকে এককভাবে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করতে। নেতা-কর্মীদের কিছুটা আশ্বস্ত করতেই হঠাৎ করে এবার সরকারবিরোধী একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মাঠ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে বিএনপি। সরকার হটাতে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই সরকারকে সরাতেই হবে। তৃণমূলে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদের পতন ঘটাতে হবে। রংপুর বিভাগের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার শুরুতে তিনি এ সব কথা বলেন।
১০টি মতবিনিময় সভার অন্যগুলো অনুষ্ঠিত হবে— ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিভাগ, ২৮ ফেব্রুয়ারি সিলেট ও খুলনা বিভাগ, ১ মার্চ বরিশাল বিভাগ, ২ মার্চ ঢাকা বিভাগ, ৫ মার্চ ফরিদপুর ও কুমিল্লা বিভাগ, ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগ, ১৪ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগ, ১৫ মার্চ রাজশাহী বিভাগ এবং ১৬ মার্চ ময়মনসিংহ বিভাগ।
২৪ ফেব্রুযারি ১২ দলীয় জোট, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট এবং এলডিপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। আগের দিন বৈঠক করেছে গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটি। ২৪ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বৈঠকে আলোচনা হয়েছে গতানুগতিক। কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ১০ দফা কিংবা ২৭ দফা কে রাষ্ট্র মেরামতের দফা মেনে নিয়েই আন্দোলনকে কীভাবে এক দফায় নিয়ে আসা যায় এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আপাতত ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে মাঠে থাকা হবে। রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে উঠবে রোজার শেষে কোরবানি ঈদের আগে। অর্থাৎ রোজা ও কোরবানি ঈদের মাঝে যে সময় সেটাকেই আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমালোচনা করে জোট নেতারা বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ শুধু রূপরেখা তৈরি করে কিন্তু রুপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, হবে সে ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্যে নেই। প্রস্তুতিও নেই। তারা আন্দোলনের রূপরেখা নয়, বেশি ব্যস্ত রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা তৈরিতে। অথচ তাদের কারণেই বিএনপির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে দীর্ঘদিনের ভোট-জোটের প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামী। আসল কথা হচ্ছে বিএনপি গণতন্ত্র মঞ্চকে যতটুকু মূল্যায়নের প্রাপ্য তারচেয়ে কিছুটা বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। অতীতেও তাদের সমন্বয়ে গঠিত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে খেসারত দিয়েছে। এখনো যদি সেই পথেই হাঁটে তাহলে বিএনপিকে আবারো চরম মূল্য দিতে হবে। আমরা এই বিষয়ে বিএনপি নেতাদের অবহিত করেছি।
১২ দলীয় জোটের একাধিক নেতারা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএনপি মহাসচিবসহ নেতারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, শুধুমাত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হচ্ছে না, হবে না। যে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অবশ্যই সবাইকে অবহিত করা হবে। যুগপৎ আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচিতে এবার আগামী ৪ মার্চ এবং ১১ মার্চ আবারো পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী কর্মসূচি প্রতিটি মহানগরের থানায় থানায় পালন করা হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানাবিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া সবাই এক দফা আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐক্যেমতে পৌঁছেছেন। যদিও তার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কোনো প্রকার রূপরেখা তৈরি করব না। ১২ দলীয় জোট বিএনপি ঘোষিত ১০ দফা এবং ২৭ দফার সবকিছুতে সমর্থন দিয়েই কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১২ দলীয় জোটের একজন নেতা ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, সত্য কথা বলতে গেলে রাজপথে দাবি আদায়ের আন্দোলনে যেতে বিএনপি এখনো নিজেরাই প্রস্তুত নয়। যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে তারাই যদি প্রস্তুতি না নেয় সেক্ষেত্রে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো শত চেষ্টা চালিয়েও কাজের কাজ কিছুই হবে না। যে যাই বলুক বিএনপি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল, যারা একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আমরা যারা বিএনপির সঙ্গে দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে অবর্তীর্ণ হতে প্রস্তুতি নিচ্ছি তাদের সঙ্গে বিএনপির সখ্যতা কতটুকু। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে তারেক রহমান বিএনপি পরিচালনা করছেন। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন, সিদ্ধান্ত তিনি নিলেও ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কাছে পরামর্শ জানতে চাইতেন। কিন্তু তারেক রহমান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন- চাইলেও সাক্ষাৎ করা যাচ্ছে না। তবে তিনি চাইলে স্কাইপিতে আমাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। এতে অনেক কিছুর অবসান হয়। কারণ বিএনপির নেতারা তারেক রহমান ইস্যুতে অনেকটাই ঠেকে পড়ে ঐক্যবদ্ধ বলে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারির পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি দেওয়া ছিল। কিন্তু বিএনপি কারো সঙ্গে কথা না বলে সময় পরিবর্তন করে কর্মসূচি পালন করেছে। যা আমাদেরক ভবিষ্যৎ আন্দোলন সংগ্রামের প্রস্তুতিতে কিছুটা ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বৈঠকে পরবর্তী কর্মসূচি ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই মুহূর্তে গতানুগতিক কর্মসূচি চলমান থাকবে। রমজানের পর বড় আকারে কর্মসূচিতে মাঠে নামা হবে। এককথায় দাবি আদায়ের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার প্ল্যার্টফর্ম তৈরিতে আরও সময় লাগবে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা ১২ দলীয় জোট বিভাগীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে শিগগিরই সফরে বের হব। এখন যুগপৎভাবে বিএনপির সঙ্গে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। এখন তো অনেক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে নানামুখী কথাবার্তা বলছেন। বিএনপিও সেগুলোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বলে আমি মনে করছি। তবে সময় বলে দেবে বিএনপির সঙ্গে কে বা কারা শেষ পর্যন্ত দাবি আদায়ে মাঠে থাকে।
এনএইচবি/আরএ