সোহেলকে ঘিরেই আটকে আছে ই-অরেঞ্জ কেলেঙ্কারির তদন্ত!
ই-কমার্সের নামে প্রতারণা ও অনলাইনে অবৈধ বহুস্তর বিপণন ব্যবসা (এমএলএম) চালিয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর গ্রাহকদের হতাশা কাটছে না। ইভ্যালির বিষয়ে হাইকোর্টের নতুন নির্দেশনায় আশা দেখছেন গ্রাহকরা কিন্তু ই-অরেঞ্জ প্রতারণা আটকে আছে তদন্তে। তবে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে তারা জমা দিয়েছেন। প্রতারণার শিকার হওয়া গ্রাহকদের প্রশ্ন— ই-অরেঞ্জ কেলেঙ্কারি তদন্তের অগ্রগতি কতদূর, দেশে কি ফেরত আসবে টাকা ও অপরাধী?
তথ্য মতে, ই-অরেঞ্জ এর মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। বর্তমানে ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষের কেউ জেলে, কেউ পলাতক। কেউবা জামিনে মুক্ত আছেন। অনেকে বলছেন, এ সবের নেপথ্যের মূল হোতা বনানী থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল ভারতে পালিয়ে যান। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন। সোহেল এখন কোচবিহারের একটি কারাগারে। গ্রাহকরা বলছেন, তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় কি ব্যর্থ হচ্ছে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ঘটনায় যে সব মামলা হয় তার তদন্তে বিশেষ কোনো অগ্রগতি নেই বলে মনে করছেন গ্রাহকরা। এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো প্রতারণা করছে এমন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটাও কাগজে কলমে থেকে গেছে বলে মনে করেন গ্রাহকরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকদের কি পরিমাণ অর্থ কোথায় সরানো হয়েছে তা সোহেল ভালো বলতে পারবেন। যে কারণে সোহেলকে ঘিরেই আটকে আছে তদন্ত। তবে বেশ কিছু মামলার তদন্তের প্রতিবেদন আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
২০২১ সালের ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে তাহেরুল নামের এক ব্যক্তি প্রথম মামলা দায়ের করেন। এরপর এক এক করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত ২৪টির বেশি মামলা হয়। এই ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ও মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু কোনো মামলার তদন্তের অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
ই-কমার্স প্রতারণার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) শিউলি আক্তার বলেন, নতুন কাউকে আপাতত গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলমান রয়েছে। তাছাড়া সোহেল রানা গ্রেপ্তার হলে অনেক কিছু জানা যাবে।
এ সব বিষয়ে পুলিশের বিশেষ শাখা সিআইডি ও পিবিআইর কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, ই-কমার্সের নামে প্রতারণা ও অনলাইনে অবৈধ বহুস্তর বিপণন ব্যবসা (এমএলএম) চালিয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৪১টিরও বেশি মামলা চলছে। এ সব মামলায় প্রায় ১১০ থেকে ১৫০ জন আসামি রয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাত রয়েছে অনেক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের বিশেষ টিম ২৯টির বেশি মামলা তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে। মামলাগুলোর বেশ কিছু তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা আছে। তা ছাড়া সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা দেশে ফিরে এলে এ সব প্রতারণার আসল তথ্য পাওয়া যাবে।
শুধু গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। এমনটা জানিয়ে সিআইডি বলছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, টোয়েন্টিফোর টিকিট লিমিটেড, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এবং সমবায় প্রতিষ্ঠান এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্তে ৫০০ কোটি টাকা অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সব ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) আইনে আলাদা আলাদা মামলা হয়। মানি লন্ডারিং আইনে হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। তবে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত প্রায় শেষ, আদালতে প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের আগ্রহ দেখছে না মামলার বাদী ও সাধারণ গ্রাহকরা। মামলার তদন্তে বিশেষ অগ্রগতি না থাকায় হতাশায় ভুগছেন তারা। তাদের দাবি, সব টাকা ফেরত পাবেন কি না তা নিয়ে বড় অনিশ্চয়তায় রয়েছেন অনেকেই। একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা বাদী এম ফরহাদ বলেন, মামলার বিষয়ে এখন আর পুলিশের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
অন্য একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা নাম বলতে অনিচ্ছুক আরেক ব্যক্তি বলেন, নিজের জমানো ও স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ৪৮ লাখ টাকার পণ্য কিনেছিলাম। টাকা ফেরত পায়নি। এখন আমার জীবন বিপর্যয়ের মধ্যে আছে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, সোহেলকে ফিরিয়ে আনতে ভারতীয় পুলিশের এলসিবি শাখায় কয়েকটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তারা কোনো চিঠির জবাব দেননি। পরে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সোহেলকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, আমাদের সিআইডির বিভিন্ন সময়ে বিশেষ কিছু অভিযানে ই-কমার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় বেশকিছু প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়। আমরা যে কোনো প্রতারণার বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা বেড়ে গেছে এরমধ্যে অনলাইন প্রতারণাটা বেশি। ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা বা যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি এবং বিশেষ নজরদারি বৃদ্ধি রেখে আমাদের বিশেষ বিশেষ টিম কাজ করছে।
এদিকে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তেমন কোনো তথ্য দিতে পারছেন না।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি-প্রশিক্ষণ) এনসিবির তৎকালীন এআইজি মহিউল ইসলাম বলেছেন, এনসিবির দায়িত্বে থাকাকালে সোহেলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের এনসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করা হত। তবে এই বিষয়টি এখন কী অবস্থায় আছে সেটি এখন বলতে পারছি না।
এদিকে সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ই-কমার্স ও অনলাইনে প্রতারণা ঠেকাতে কঠোরভাবে কাজ করছে তারা।
জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, ই-কমার্স ও অনলাইনসহ মানি লল্ডারিংয়ের মামলাগুলো বেশ আমলে নিয়ে সিআইডি কাজ করে যাচ্ছে। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইনে বিনিয়োগসহ ঋণ প্রদানের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজারো কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগে ২৬টির বেশি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সিআইডি এ সব প্রতারণা ঠেকাতে অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নজরদারি চলমান রেখেছে। তিনি বলেন, সিআইডি যেসব মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিল প্রায় অধিকাংশ মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে বলে জানতে পেয়েছি।
কেএম/আরএ/