‘গরু-খাসি তো আগেই বাদ, এখন মুরগিও কিনতে পারব না’
‘দেশে কি দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে। যে যার মতো দাম নিচ্ছে। কয়েক দিন আগে যে মুরগি ১৬০ টাকা কেজি কিনেছি। বর্তমানে তা ২৩০ টাকা। তাহলে আমরা খাব কী? গরু, খাসিতো ঈদ ছাড়া চোখে দেখি না। এখন তো দেখছি মুরগিও কিনতে পারব না।’
মোহাম্মদপুরের স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের বাসিন্ধা রিকশাচালক আবুল কালাম বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ব্যাপারে এমন করেই নিজের হতাশা প্রকাশ করছিলেন।
বাংলামটরের বাসিন্ধা এন্তাজ উদ্দিন। সদ্য অবসরে যাওয়া একজন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ১৪০ টাকার মুরগি আজকে (সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি) ২২০ টাকা কেজি কিনতে হলো। খুবই খারাপ অবস্থা। দাম বেড়ে যাওয়ায় কেনাও কমিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে এন্তাজ বলেন, ‘আগের মতো কিনতে পারি না। আগে প্রতি সপ্তাহে ৫/৬ কেজি কিনতাম। এখন অর্ধেক হয়ে গেছে। জীবনে কখনো এত দাম বৃদ্ধি দেখিনি। এই দাম থাকলে তো আমার মতো ক্রেতারা নিরুপায়। হাত পা বাঁধা। কী করব।’
শুধু এন্তাজ উদ্দিনিই নয়, এই অবস্থা তার মতো আরও বহু পরিবারের। ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এই আমিষও চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। রাজধানীর কাপ্তান বাজারে পাইকারি পর্যায়ে এসে সেই মুরগির দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২০৫ টাকা। আর খুচরা পর্যায়ে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা। অর্থাৎ সাধারণ ক্রেতাদের হাতে যেতে যেতে প্রতি কেজি মুরগিতে দাম বেড়েছে ৬০ টাকা।
অপরদিকে, সোনালি মুরগি হিসেবে পরিচিত কক মুরগি খামার পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৭০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে ১০ টাকা বেড়ে ২৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাদেরকে কিনতে হচ্ছে ৩৪০ টাকায়। অর্থাৎ পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের গুণতে হচ্ছে কেজিতে ৭০ টাকা বেশি।
ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে মুরগির মাংস। গরু ও খাসির মাংস তো আগেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এখন মধ্যবিত্তের শেষ অবলম্বন মুরগির মাংসও হাতছাড়া।
গত কয়েকদিন ধরেই ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়ে বিক্রেতারা ইচ্ছামত দাম আদায় করছে। কিন্তু কেউ দায় নিতে চাচ্ছে না। খামার থেকে শুরু করে রাজধানীর আড়ত, পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এবং সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে মুরগির বাজারের অস্থিরতার এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
সারা দেশের খামারগুলোতে মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে কাজী ফার্মস, প্যারাগন, নারিশসহ অসংখ্য কোম্পানি। খামারিরা সেই বাচ্চা বড় করে কেজি দরে বিক্রি করে। আগে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি হলেও এখন সেই দামে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর জেনারেল সেক্রেটারি মাহবুবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা সারা দেশে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে থাকি। খামারিরা তা বড় করে বিক্রি করে। আগে ফার্মে ১৫০ থেকে ১৬০ কেজি ব্রয়লার বিক্রি করা হলেও বিভিন্ন কারণে দাম বেড়ে বর্তমানে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকারিতে তা ১৯০ টাকা কেজি। তবে এলাকা ভেদে একটু হেরফের হতে পারে।
খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মুরগি কেন ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অন্যায্য, অযৌক্তিক। এটা হতে পারে না। সরকারকে তা দেখা দরকার। কারণ, একদিকে করোনার পর উৎপাদন কমে গেছে। অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। আগে প্রতিদিন এক কোটি ৬০ লাখ মুরগি উৎপাদন হলেও বর্তমানে সেই উৎপাদন কমে এসেছে এক কোটি ২০ লাখে। অন্যদিকে, খুচরা বিক্রেতারা অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে। এভাবে চলতে থাকলে এই নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য কেনা মানুষ বন্ধ করে দেবে। যেমনটা গরু ও খাসির মাংস বন্ধ হয়ে গেছে। তখন নতুন প্রজন্ম আমিষহীন হয়ে পড়বে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সোনালি মুরগি আমাদের সংগঠনের বাইরের হিসেব। তারপরও সংগঠন থেকে একটা মূল্য তালিকা করা হয়। সেখানে দেখা যায় গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলাতে পাইকারি পর্যায়ে সোনালি মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের আদর্শ চিকেন হাউজের ম্যানেজার সেরাজুল ইসলাম জানান, সোনালি মুরগি (পাকিস্তানি) ৩৩০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এটা ১৫ দিন আগে ২৮০ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়েছে। ১০-১৫ দিন থেকে দাম বেশি। বেশির ভাগ নরসিংদী থেকে আনা। তিনি জানান, সোনালি মুরগি ২৮০ টাকা কেজি দরে কেনা। কাপ্তান বাজারে নগদে কিনতে হয়, আবার দামও বেশি। তাই অন্য জায়গা থেকে বাকিতে আনা হয়। আর ব্রয়লার মুরগি কেনা হয় ২১০ থেকে ২১২ টাকা কেজি। বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। পার্থক্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা।
এতবেশি লাভ কেন জানতে চাইলে সেরাজুল বলেন, খরচ আছে না। বর্তমানে ব্রয়লারে ১০ টাকা, আর অন্যটাতে ২০ টাকা লাভ হয়। তারপরও আগের চেয়ে এই লাভ কম। কারণ আগে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা লাভ হতো। মূল্য তালিকায় ব্রয়লার ২৩০ টাকা, পরিচিত হলে ১০ টাকা কমিয়ে ২২০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। যারা দাম করে না বা কম নেয় এমন ক্রেতাদের কাছে তালিকা অনুযায়ী দাম নেওয়া হয়।
কারওয়ানবাজারের ব্রাদার্স চিকেনের ম্যানেজার মো. হাসান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রহিম, আনোয়ার ও ব্রাদার্স পোল্ট্রি হাউজ বিভিন্ন জায়গা থেকে মুরগি নিয়ে আসে। পোল্ট্রি বিক্রি করা হচ্ছে ২৩০ টাকা কেজি। ১০ থেকে ১২ দিন থেকেই এই বাড়তি দাম।
কেনা কত করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানি না। মহাজন কামাল জানে। আমার কেনা দাম জানা নেই। মহাজন শুধু বিক্রির কথা জানায়। বাড়তি দামের ব্যাপারে হাসান আরও বলেন, অর্ডার বেশি, কিন্তু মাল কম। তাই দাম বেশি।
একই বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী সুমন বলেনমুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গেছে। আগে যে ৫ কেজি কিনত, এখন আড়াই কেজি কিনছে। বিক্রি অর্ধেকে নেমে গেছে।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রমজান, শব-ই বরাত ঘনিয়ে আসছে। এ ছাড়া, বিয়ে শাদী, বিভিন্ন উৎসব বেশি হচ্ছে। চাহিদা বাড়ছে। তাই দাম আরও বাড়তে পারে। তবে ৫ থেকে ১০ রোজা পর্যন্ত দাম আবার কমবে। কারণ ওই সময়ে চাহিদা কমে যাবে।
কারওয়ানজাবারে কথা হয় একাধিক ক্রেতার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকে কর্মরত রাফাত নামে এক ক্রেতা বলেন, আগে দেশি মুরগি কিনেছি ৫০০ টাকা কেজি। আজ কিনলাম ৫২০ টাকায়।
তিনি আরও বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় কেনাও কমিয়ে দিয়েছি। আগে সপ্তাহে একসঙ্গে ১২টা কিনলেও এখন কিনছি অর্ধেক। তিনি আরও বলেন, বিক্রেতারা চালাকি করে পাকিস্তানিটা দেশি বলে চালিয়ে দিচ্ছে। ধরা খুব মুসকিল। এতে তারা আরও বেশি করে লাভ করছে।
দনিয়া থেকে আসা বাহাউদ্দিন নামে এক ক্রেতা বলেন, মুরগি কেনা অর্ধেকে নামিয়ে দিয়েছি। আগে ৭ থেকে ৮টা কিনতাম। এখন তিনটা কিনলাম। এত দাম কী করব। উপায় নেই। আয় বুঝে ব্যয় করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেট ও টাউনহল বাজারেও দেখা গেছে একই চিত্র। বিক্রেতারা বেশি দামে কেনার কথা বললেও বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। বিভিন্ন ফার্ম থেকে কম দামেই বিক্রি করা হচ্ছে পোল্ট্রি, সোনালি ও লাল এবং দেশি মুরগি।
মনির হোসেন নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘মুরগির দাম তো বাড়ছেই। বেশি দাম হওয়ায় কেনা কঠিন হয়ে গেছে। এখন খাওয়া কমিয়ে দিতে হচ্ছে। কারণ, আয় তো আর বাড়েনি। তাই আগের আয়ে আগের মতো মুরগি কেনা সম্ভব না।’
ভোক্তা আইনে সব পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য তালিকা দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখার নিয়ম থাকলেও মুরগি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। তারা শুধু বিক্রয় মুল্যের তালিকা দোকানে ঝুলিয়ে রেখেছেন। কিন্ত কতো দামে কেনা তা লিখেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সব জায়গায় পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য তালিকা প্রকাশ করতে হবে। পোল্ট্রি শিল্প প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তাই এটা নিয়ে অতো কাজ করা হয়নি। তবে ফার্ম থেকে পাইকারি ও খুচরা মূল্যের এত বেশি ফারাক হতে পারে না। এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। এর আগে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এটা দেখা দরকার। কারণ, মুরগির এমআরপি তো দেওয়া হয় না। কে কত লাভ করতে পারবে এটা তাদের বলা ও দেখা দরকার। এরপর কেউ বেশি দাম নিলে আমরা তখন ধরতে পারব।
এনএইচবি/এমএমএ/