তিন স্তর ঋণে কমানো হবে খেলাপী
করোনায় সব কিছু এলোমেলো হলেও কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে টিকে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এজন্য কৃষককে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য তিন স্তরে ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে রূপালী ব্যাংক। এতে খেলাপী ঋণ হবে না। কারণ কৃষক ও উদ্যোক্তারা পণ্যের নার্য্যমুল পাবে। করোনা মোকাবেলা করে এভাবে সামনে এগিয়ে যেতে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেছেন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকাপ্রকাশের সিনিয়র রিপোর্টটার জাহাঙ্গীর আলম।
ঢাকাপ্রকাশ: তৃণমূলে গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের সেবা পৌছে দিতে কি উদ্যোগ নিয়েছেন?
মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ: ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থা বড় করপোরেট হাউসে সীমাবদ্ধ। তাই তৃণমূলে ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে দিতে চলতি বছরে একেবারে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব প্রডাক্ট (পণ্য) দিগন্ত সূচনা করবে। এতে ঋণের বোঝাও কমবে। তা হচ্ছে তিন স্তর বিশিষ্ট (থ্রি টায়ার) কন্ট্রাক্ট ফামিং। আগে শুধু উৎপাদকদের ঋণ দেওয়া হতো। এখানে তিনটি পক্ষ অর্থাৎ উৎপাদক, সরবরাহকারি ও ক্রেতাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাতে কৃষক, সরবরাহকারি ও ক্রেতা কেউ খেলাপী হবে না। এটা একেবারে নতুন ধারণা। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরুন আগে কোনো কৃষক ১০০ টাকার পণ্য বাকিতে বিক্রি করতো। মধ্যস্বস্তভোগিদের দখলে চলে যেত। বাকিতে বিক্রি করায় তারা টেনশনে থাকত। নতুন ধারনায় তারা টেনশন ছাড়াই সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারবে করপোরেটদের কাছে। পণ্য (মাল) দিতেই থাকবে। আমরাও বলব তোমরা মাল দাও। টাকা কোনো ফ্যাক্টর না। কনসেপ্ট ক্রিয়েট (ধারণা সৃষ্টি) করা হচ্ছে। পারটেক্স, প্রাণ ও বসুন্ধরার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে মাল দিলেও কোনো ভয় থাকবে না। তাদেরকে আমরাও বলব মাল নাও। তারা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবন্ধ থাকায় ভয়ের কিছু নেই। ব্যাংকিংখাতে সুবাতাস এটা। খেলাপী ঋণ কমন সাবজেক্ট হলেও কিন্তু থ্রি টায়ারে কোনো খেলাপী ঋণ হবে না। কোনো সুযোগ নেই। অন্য ব্যাংকগুলোও এটা অনুসরণ করতে পারে। এতে খেলাপী ঋণ কমে যাবে। কারণ হলো এটা ব্লক চেইঞ্চ। মুজিববর্ষে ১০০টি শাখা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২৩টির অনুমোদন পাওয়া গেছে। আমাদের ৫৮৬টি শাখা রয়েছে, তা থেকে বেড়ে ৬৮৬টি শাখা উপশাখা করা হবে। এসব শাখার মাধ্যমে তৃণমূলে ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দেওয়া হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: চলতি বছরে উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি?
মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ: রূপালী ব্যাংক হেরিটেজ (ওতিহ্য) রক্ষা করতে উদ্যোগ নিয়েছে। অষ্টগ্রাম ও গাইবান্ধার বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া পণ্যের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেহেতু কৃষি ব্যাংক বেশি ঋণ দেয় কৃষকদের। তাই সব কৃষিপণ্যে ঋণ না দিয়ে শুধু হেরিটেজ ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার গামছা, কাঁসা, পিতল, শীতলপাটি, ঝিনুকসহ হারিয়ে যাওয়া পণ্য পুনরুদ্ধারে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখাতে সুদের হার হচ্ছে ৯ শতাংশ।
ঢাকাপ্রকাশ: ব্যাংকে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। তা রোধ করতে কি উদ্যোগ নিয়েছেন?
মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ: ঋণ বাড়িয়ে লাভ করাটা বড় কথা না। কারণ ব্যাংকে গালাগালি করলেও ঋণ আদায় হয় না। ধাক্কা দিয়েও সরানো যাচ্ছে না। ফলে খেলাপী ঋণ কমছে না। তাই ব্যাংকের করপোরেট গভর্নেন্সেরও উদ্যোগ নেয়া গয়েছে। রূপালী ব্যাংকে চালু করা হয়েছে ‘ঝুকি রেজিস্টার ও ঝুকি ড্যাসবোর্ড’। ইয়োলো, গ্রীন ও রেড সিগনাল এই তিনটি চিহ্য থাকছে। ৪২টি বিভাগ রয়েছে আমাদের ব্যাংকে। কোথাকার কি অবস্থা আমরা তা জানতে পারছি। সিগন্যাল বুঝে সমস্যা নিরূপন করে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা কমাতে সিস্টেম থাকতে হবে। সিস্টেম থাকায় সিঙ্গাপুরে কেউ চুরি করে না। প্রথমবারের মতো সাইবার সিকিউরিটি চালু করা হয়েছে। আমরা প্রথমবারের মতো চালু করেছি।
ঢাকাপ্রকাশ: ব্যাংকে করোনার প্রভাব কেমন পড়েছে?
মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ: করোনায় লাক্সারী পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ সব বন্ধ হয়ে যায়। নতুন জুতা, স্যান্ডেল কেউ কিনেনি। সার্ভিস খাত বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ত ধান, দুধ, আটার উৎপাদন বন্ধ থাকেনি। পণ্যের উৎপাদন ও প্রবাহ চলতে থাকে। কৃষি ক্ষেত্রে এক দিনেও উৎপাদন বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় করোনায় মানুষ না খেয়ে কেউ মারা যায়নি। ওষুধের প্রবাহ, খাদ্যের প্রবাহ সচল ছিলো। এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে। এরফলে পৃথিবেীতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমলেও আমাদের জিডিপি ভালো করেছে। আগের চেয়ে কমলেও পাঁচ শতাংশের উপরে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিলো। যেখানে বিশ্বের অনেক দেশে শূণ্যে নেমেছে। দেশের অবস্থা ভালো থাকায় রূপালী ব্যাংকের মুনাফাও ভালো করেছি। কিছুটা কমলেও করোনায় আমরা খুব ভালোভাবে টিকেছি। ২১ সালেও ভালো করেছি। ১৫০ কোটি টাকা লাভ করেছি। কৃষি সচল ছিলো। তারা ভালোভাবেই টিকেছিলো। ব্যাংকও ভালো করেছে। টিকে ছিলো।
ঢাকাপ্রকাশ: মুজিববর্ষে রূপালী ব্যাংক কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলো?
মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ: মুজিববর্ষে শুভ দিন শূণ্য সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ করোনা অতিমারিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সব কিছু স্থবির হয়ে যায়। মানুষ ঘরে ছিলো। কিন্তু কৃষিই আমাদের উপজীব্য। তাই প্রান্তিক চাষিদের জন্য টমেটোতে শূণ্য সূদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এটা অনেকে বুঝে না। মধ্যস্বত্বভোগি ও ফোরিয়াদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের কন্ট্রাক্ট ফার্মিং যুক্ত করা হয়। জনপ্রিায় করা হয়েছিলো। প্রাণকে আনা হয়েছিলো। কারণ তারা সারা দেশে সব পণ্য সংগ্রহ করে। এতে কৃষকরা পণ্য বিক্রি করে নার্য্যমূল্য পেয়েছে। পরিবহন খরচ ও সুদ বিহীন ঋণ পেয়েছে। নতুন ধারণা। উন্নত বীজ ও বিপনন ও ন্যায্যমূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। শতভাগ আদায় হয়েছে এই ঋণ। হোলসেল ল্যান্ডিং ও কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সারা দেশে ঋণ বিতরণ ও আদায়ে দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
এছাড়া স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ১০ জানুয়ারি রূপালী ব্যাংক ইসলামিক উইন্ডো চালু করা হয়েছে। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উদযাপনও করেছে রূপালী।
ঢাকাপ্রকাশ: করোনকালে প্রান্তিক চাষিদের কি কোনো সহায়তা দেওয়া হয়েছে?
মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ: ২০২০ সালে দেশ করোনায় আক্রান্ত হলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই খামারী, আম চাষী ও মসলা চাষীদের বিশেষভাবে সহায়তা করা হয়েছে। কারণ হলো করোনায় খামারীরা ন্যায্য দাম না পেয়ে দুধ ফেলে দিত। ক্ষতিগ্রস্থ খামারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন প্রণোদনা প্যাকেজ। তাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রান্তিক কৃষক ও খামারীদের কথা বিবেচনা করে দুধ ফেলে না দিয়ে ঘি তৈরি করার উদ্যোগ নেয় রূপালী ব্যাংক থেকে। করোনাকালে ‘দুধ না ফেলে ঘি বানান, দুগ্ধখাতে জাগুক প্রাণ’ শ্লোগান ধারণ করে চাষিদের পাশে দাঁড়ালাম। চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত মিল্কভিটার সঙ্গে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর চুক্তি করা হয়। খামারীদের সুযোগ করে দিতে এক হাজার কৃষককে প্রথমে পাঁচ কোটি থেকে পরে ১০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। কারণ ঘি দীর্ঘ দিন থাকে, নষ্ট হয় না। মিল্কভিটা খামারীদের ঋণের কিস্তি জমা দিয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের ফলে দেশের কোনো মানুষ না খেয়ে মারা যায়নি।
মধু মাসে আম্ফানে আমেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই আমের সঠিক দাম নিশ্চিত করতে ‘মধু মাসে ঝরুক মধু ফলাও বেশি আম মুকুল থেকেই সকল স্তরে পাবে সঠিক দাম’ শ্লোগানে আম চাষিদের জন্য ১৯০ দিনের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাণের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। কারণ প্রাণ বাকিতে আম কিনে না। প্রাণের মাধ্যমে আম চাষিদের শূণ্য সুদে বা সুদবিহীন ১০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
‘দেশের পাড়ার জাগলো বলে বাংলাদেশ আজ ধন্য আদা-হলুদ করবে আবাদ সারাদেশের জন্য’ স্লোগান ধারণ করে রেয়াদী চার শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ আদা আমদানি করতে অনেক অর্থ বাইরে চলে যায়। অপরদিকে বান্দরবন ও খাগড়াছড়িতে ব্যাপক আদা চাষ হলেও চাষিরা দাম পাই না। তাই আদায় দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এনজিও পদক্ষেপের মাধ্যমে পাহাড়ে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেড় লাখ আদা চাষিকে চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। প্রতি সদস্যকে এক লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। যাতে আদমানি কমে। দেড় লাখ টন চাহিদা। উৎপাদন হয় ৩৭ হাজার টন। এভাবে উৎপাদন বাড়লে আদা আমদানি করতে হবে না।
জেডএ/