অজ্ঞতায় ম্লান শহীদের বীরগাথা
যুদ্ধ মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয়, ভীরু ব্যক্তিকে বীর সৈন্যে আর আপসকামী ব্যক্তিকে সাহসী যোদ্ধায় পরিণত করে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও পাল্টে দিয়েছিল হাজারো মানুষের জীবনবোধ, জন্ম দিয়েছিল শত বীরের। আব্দুল হালিম মিয়া সেরকম একজন বীরযোদ্ধা, দেশমাতৃকার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে যিনি অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
হালিম মিয়া ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং একাত্তরে তিনি প্রধান করণিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডে। আর দশজন সাধারণ সাংসারিক মানুষের মতো তিনিও সাধারণ জীবন-যাপন করতেন; কিন্তু একাত্তরের সেই আগুনঝরা দিনগুলো তাকেও পরিণত করেছে একজন যোদ্ধায়।
’৭১-এর ২৬ মার্চ, কারফিউ চলছিল রাজশাহী শহরজুড়ে। প্রাণ বাঁচাতে যুবকরা যে যার মতো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। ঠিক সেই সময় মধ্যবয়সী এই সরকারি কর্মকর্তা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে। অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও দুর্বল হয়ে পড়েননি, মাথা নত করেননি, অবশেষে বরণ করেছিলেন শহীদের মৃত্যু।
সেই গর্বের গল্পটি বলছিলেন হালিম মিয়ার বড় সন্তান শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ কালরাত। সে রাতে ভয়াবহ গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আমরা শুনলাম স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ভীষণ লড়াই চলছে। সকালে কারফিউ ছিল। এলাকার যুবকেরা তাদের স্ত্রী সন্তানদের বাড়িতে ফেলে লুকিয়েছিল নিরাপদ জায়গায়।’
‘দুপুরের কিছু আগে দুটি মর্টার শেল এসে আঘাত হানে এলাকায়। নারী এবং শিশুরা ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। কান্নাকাটি শুনে আমার বাবা জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে এলাকার নারীদের সাহস দিতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা বিষয়টি বুঝতে পেরে বাবাকে ধরে ফেলে। বাবার সঙ্গে আরও দুজন যুবক, কালু আর সামুকেও তারা উঠিয়ে নেয়’, বলেন শামসুল।
অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় কালু আর সামুকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু আমার বাবা ফেরত এলেন না। পরদিন সকালে বর্ণালীর মোড়ে আমার বাবার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেল।’
কালু এবং সামু ছিলেন দুই ভাই, বর্তমানে তারা দুজনই মৃত। মৃত্যুর আগে কালু সেদিনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দিদশার কথা আমাদের বলে গেছেন।
তিনি বলে গেছেন, ‘আমরা দেখলাম এলাকার অনেক যুবক এবং ছাত্রদের তারা পিলখানায় স্থাপিত ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে এবং বিনা কারণে তাদের অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের টার্গেট ছিল শিক্ষিত মানুষ। আমরা দুই ভাই যেহেতু এতটা পড়ালেখা জানতাম না, তারা আমাদের ছেড়ে দিল; কিন্তু শিক্ষিত কাউকেই ছাড়তে তারা নারাজ।’
কালু আরও বলেছেন, ‘সেনাদের জেরার মুখে ভয়ে বেশিরভাগ মানুষ চুপ করে ছিল, কয়েকজন শব্দ করে কান্নাকাটি করছিল। হালিম মিয়া একটুও ভয় পেলেন না। তিনি সেনাদের মুখে-মুখে তর্ক করতে শুরু করলেন। অন্যদের যেন নির্যাতন না করা হয়, সে ব্যাপারে বারবার বলতে থাকলেন।’
জানা যায়, এরপরই তাকে আরেকটি কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। অথচ এই শহীদের বীরত্বগাথা নিয়ে কোনো লেখা বা তার কোনো স্মৃতিচিহ্নই নাই শহরে।
আক্ষেপ করে শামসুল বললেন, ‘বাবার নামে আমাদের বাড়ির সামনের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হলেও, অনেকদিন যাবৎ সেখানে কোন নাম ফলক নাই। এই বিষয়টি তদারক করারও তেমন কেউ নাই।’
এই হলো একজন শহীদের গল্প, এই গল্প এখানেই শেষ। এলাকার কিছু মানুষ এখনও তার কথা মনে রেখেছে।
এ রকম আরেকজন হলেন আব্দুস সালাম, যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সেনাদের ক্যাম্পে কাপড় ধোয়ার কাজ করে গোপন সংবাদ নিয়ে পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
শামসুল আলম বলেন, ‘সঠিক তারিখ মনে নেই। মার্চের শুরুর দিকে, সেটি আট বা দশ মার্চ হবে। একদিন হালিম মিয়া এলেন আমার আব্বার কাছে। আব্বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার যুদ্ধ বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা। তাই হালিম মিয়া আব্বাকে বললেন, বিশটি বন্দুক আর ২০০ গুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা ঠেকানো সম্ভব কি-না? আব্বা বললেন, এটি বোকামি হবে, এভাবে তাদের ঠেকানো যাবে না। তাদের গেরিলা পদ্ধতিতে প্রতিহত করতে হবে। হালিম মিয়া ফিরে গেলেন।’
শামসুল অবশ্য বললেন ভিন্ন কথা। তিনি জানালেন, তার বাবার এ রকম কোনো ইচ্ছার বিষয়ে তারা কিছুই জানতেন না।
তবে কালু বলেছিলেন, হালিম মিয়ার কথা শুনেই মনে হয়েছিল তিনি অনেক গোপন পরিকল্পনা জানতেন এবং সে কারণেই পাকিস্তানি সেনারা তাকে মেরে ফেলে।
মৃত্যুর আগে তিনি বারবার বলেছিলেন, ‘এ দেশে পাকিস্তানিরা কখনওই জয়ী হতে পারবে না।’
এমএস/এসএ/এএন