ডিসেম্বর ধামাকা: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নয়া চমক!
আর কয়েক দিন পর নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরুতে পিকনিক, কার্নিভালসহ হাজারো মজার পসরা নিয়ে শহর কলকাতায় হাজির হয় শীত। আর সেই শীতের অপেক্ষায় দিন গোনে বঙ্গবাসী। কিন্তু এবারের ডিসেম্বরটা কি খানিকটা আলাদা হতে যাচ্ছে? ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ রাজনৈতিক সমীকরণ কিন্তু সেই রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত তিন-চার মাস ধরেই বিজেপি বলে আসছিল, ডিসেম্বরের জন্য অপেক্ষা করুন, বড় চমক আসতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। উল্লেখ্য, এমন একটা সময় বিজেপির রাজ্য নেতারা ডিসেম্বর ধামাকার কথা বলতে শুরু করেছিলেন, যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করেছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ বান্ধবী অর্পিতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে নগদ প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা। মোট উদ্ধার হয়েছিল কয়েকশো কোটি টাকা। সারা বিশ্বের মানুষ টিভির পর্দায় মন্ত্রীমশাইয়ের এই কাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। সে সময়ই বিজেপি ডিসেম্বর ধামাকার কথা প্রথম বলে। আর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি এসে সেই ডিসেম্বরের কথাই বলতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও। তাদেরও দাবি, ডিসেম্বরেই বড় চমক দেখবে রাজ্যবাসী। চমক কি একটাই? নাকি একাধিক চমক? এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরেফিরে আসছে পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে।
রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারী, সাবেক বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ সবাই বলতে শুরু করেছিলেন, ডিসেম্বর মাসেই দেখবেন সব ওলেটপালট হয়ে যাবে। এমনকী বর্ষীয়ান অভিনেতা, তথা বিজেপি নেতা মিঠুন চক্রবর্তীও কলকাতা সফরে এসে একই কথা বলেছিলেন। পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল সরকারের দুর্নীতির অবসান ঘটতে চলেছে। কিন্তু কীভাবে? সেটা এখনো পর্যন্ত খোলসা করেনি বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্ব। আর তা থেকেই শুরু হয়েছে জল্পনা। এই জল্পনায় প্রথমেই রয়েছে এই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের ঘোষণা। গোটা দেশে একাধিক রাজ্যে বিজেপি কোনো না কোনো সময় বিরোধী সরকার ফেলে দিয়ে নিজেদের সরকার গঠন করেছে। ফলে সেক্ষেত্রে এ কথা মনে আসা স্বাভাবিক যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে সরকার ফেলে দিতে পারে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি নিয়েও কম জলঘোলা হচ্ছে না। বিজেপি নেতারা যেমন প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে বলে বেড়াচ্ছেন সাবেক শিক্ষা, বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পরে আরও বড় কোনো মন্ত্রীও গ্রেপ্তার হতে পারেন। তৃণমূলের প্রথম সারির প্রায় প্রত্যেক নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডির পরবর্তী টার্গেট বলে বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই বলে বেড়ান। তাহেল কি বড় কোনো মাথা তদন্তকারী সংস্থার জালে পড়তে চলেছে?
কে বা কারা হতে পারেন সেই নেতা-মন্ত্রীরা? বিজেপির এক শ্রেণির নেতার দাবি, অপেক্ষা করুন না, কে বলতে পারে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা তার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই গ্রেপ্তার করা হবে না? এই বিকল্পটি বেশি করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে কারণ অভিষেক এবং তার স্ত্রী-শ্যালিকাসহ পরিবারের অনেককেই সিবিআই এবং ইডি একাধিক আর্থিক অনিয়মের কারণে তলব করতে শুরু করেছে। বিজেপির শাসনে কোনো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জেলে যাওয়ার ঘটনা বিরল নয়। ফলে সেই সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিজেপি নেতারা প্রকাশেই বলছেন, ডিসেম্বর মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে পুরোপুরি অচল করে দেওয়া হবে।
সর্বশেষ যে সম্ভাবনাটি উঠে আসছে, সেটি হলো— তৃণমূলে বিরাট ভাঙন। দলটির বেশির ভাগ নেতা ও মন্ত্রী নিমজ্জিত হয়ে রয়েছেন পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতিতে। ফলে তদন্ত এড়াতে তারা যে কোনো মুহূর্তে দল বদল করে বিজেপিতে সামিল হতে পারেন। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছে বঙ্গ বিজেপিতে। একদা তৃণমূলের দু’নম্বর নেতা মুকুল রায়, শুভেন্দ অধিকারীসহ বেশ কিছু প্রথম সারির মন্ত্রী বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। মুকুল অবশ্য পরে আবার তৃণমূলে ফিরে গেছেন। এই সম্ভাবনাটির কথা কলকাতা ও উত্তরবঙ্গে একাধিক সাংবাদিক সম্মেলন করে বলে গেছেন মিঠুন চক্রবর্তীও। তিনি দাবি করেছেন, তৃণমূলের প্রায় তিরিশ-পয়ত্রিশ জন বিধায়ক তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন। যে কোনো সময় তারা বিজেপিতে যোগদান করতে পারেন।
অন্যদিকে তৃণমূলের তরফেও ডিসেম্বর ধামাকার কথা বলা হয়েছে। এদিনই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, ডিসেম্বর মাসে বিজেপিতে বিরাট বড় ভাঙন ঘটতে চলেছে। তার দাবি, আগামী মাসে বিজেপি থেকে বেশির ভাগ বিধায়কই তৃণমূলে চলে আসবেন। ওদের তিরিশজন বিধায়কও থাকবেন না।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা দাবি করেছেন, ডিসেম্বর মাসে বিজেপি সারা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করার ছক কষেছে। যার সূত্র ধরে অশান্ত করা হবে পশ্চিমবঙ্গকেও। দেশব্যাপী সেই অশান্তির পরিবেশেই বিজেপি সরকার ভারতের সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো বিতর্কিত বিলটি আনতে পারে। ঘোলা জলে মাছ ধরার পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে। মমতার আরও দাবি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একনায়কতন্ত্রের দিকে যেতে চাইছেন। সেই লক্ষ্যেই দেশের একাধিক প্রান্তে অশান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হতে পারে বলে তার আশঙ্কা।
একই সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দাবি, ডিসেম্বর মাসে বিজেপিতে ভাঙন ধরিয়ে দলটিকে এ বাংলায় নখদন্তহীন করে ফেলা হবে। এতগুলো সম্ভাবনা নিয়ে রাজ্যজুড়ে চলছে আলোচনা। সত্যি সত্যিই কি বড় চমক অপেক্ষা করছে ডিসেম্বর মাসে? নাকি শেষ পর্যন্ত পর্বতের মূষিক প্রসবই হবে? এখনই তা জানা না গেলেও, রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ যে তুঙ্গে পৌঁছে দিতে পেরেছে বিজেপি আর তৃণমূল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরএ/