নতুন ড্যাপে ‘মহামন্দা’ রাজধানীর জমি ব্যবসায়
গুলশানে প্লট কিনতে চেয়েছিল একটি সুপরিচিত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। সবকিছু ঠিকঠাক। বাগড়া বাধল নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রজ্ঞাপন নিয়ে। প্রজ্ঞাপনের পর কোম্পানিটি জমি কিনতে অস্বীকৃতি জানাল।
কোম্পানির নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিনিধি তৌহিদুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সাধারণত কোম্পানি জমি কেনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। আমরা জমি নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে কত বর্গ ফুট ভবন হবে সেটি নির্ধারণ করেছিলাম। কিন্তু নতুন ড্যাপে যে নিয়ম করা হয়েছে তাতে ভবনের পরিমাণ অর্ধেক কমে যায়।
তৌহিদুর রহমান বলছেন, এ কারণে আমরা বিক্রেতাকে বলেছি, যদি ড্যাপ সংশোধন হয় তাহলে আমরা জমিটি কিনব। সংশোধন না হলে প্রকল্প স্থগিত থাকবে।
জমিটির মালিক মোতালেব হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এমনিতেই এখন জমি কেনাবেচা হয় খুবই কম। যখন একটা বায়ার রেডি হলো তখন এই ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি হলো। এটাকে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি-ই-বা বলতে পারি।
জসিম উদ্দিন নামে জমি কেনাবেচার একজন ব্যবসায়ী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এমনিতেই জমিজমার ব্যবসা মন্দা। যাদের কাছে টাকা আছে তারা জমি কিনবে না। আবার যাদের জমি লাগবে তাদের কাছে টাকা নেই। অবস্থা এমন হয়েছে যে অনেক দলিল লেখক পেশা পরিবর্তন করতে চাইছেন। যদিও দিনে দুয়েকটা দলিল হতো, ড্যাপের প্রজ্ঞাপনের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এটাকে আপনি মহামন্দা বলতে পারেন।
রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার জমির ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, এমনিতেই ঢাকা শহরে জমির দাম বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এত দামী জমি কিনে অর্ধেক ছেড়ে দিয়ে নির্মাণ কাজের বিধান করায় জমি কেনাবেচাই প্রায় থেমে গেছে।
গত ২৩ আগস্ট ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। প্রজ্ঞাপনের যে জায়গায় বিপত্তি বাধে সেটি হলো, ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় অর্ধেক জমি ছেড়ে দিতে হবে। এ ছাড়া ছোট জমির ক্ষেত্রে পরিকল্পনাই দেওয়া হবে না। ছোট জমির মালিকরা কয়েকজন মিলে এক হয়ে ভবন নির্মাণ করতে পারবেন।
এ অবস্থায় ড্যাপের গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নতুন গেজেট অনুযায়ী অন্যদের মতো আমিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আমার ৫ কাঠার একটি প্লট রয়েছে যেটা ২০১০ সালের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আমার প্লট ড্যাপের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছি।
ড্যাপের এই নিয়মের কারণে নতুন করে আবাসন কোম্পানিগুলোও কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছে না। আগের প্রকল্পগুলোই শেষ করছে। কারণ নতুন ড্যাপ মেনে প্রকল্প করলে ফ্ল্যাটের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাবে যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
জানতে চাইলে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি কামাল মাহমুদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সাধারণ জমির মালিক যাদের ছোট ছোট জমি আছে তারা বেশি সমস্যায় আছে। কারণ এখনো ৭০ ভাগ বাড়িই ৩ থেকে ৪ তলা।
এক প্রশ্নের জবাবে কামাল মাহমুদ বলেন, ভাইয়ে ভাইয়েই বিবাদ লেগে থাকে। সেখানে অন্যের সঙ্গে জমি শেয়ার করে কীভাবে প্লট করবে? এটা একটা জুলুমের মতো হয়ে গেছে।
কামাল মাহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পূর্বাচলে বরাদ্দ পাওয়ার পর ৩/৪ কিস্তি দিয়েই সেটি এক কোটি টাকা কাঠা বিক্রি করা যাচ্ছে। সেই প্লটে কবে বাস করা যাবে তার ঠিক নেই। অথচ যে প্লটে মানুষ বংশ পরম্পরায় বসবাস করছে সেই প্লটে আপনি ২/৩ তলার উপরে করতে পারবেন না এটা কেমন কথা?
অবশেষে ড্যাপ সংশোধনের ইঙ্গিত
এ অবস্থায় ড্যাপ সংশোধনের ইঙ্গিত দিয়ে প্রকল্প পরিচালক রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলছেন, নগরবাসী ও আবাসন শিল্পের কল্যাণে আলোচনার মাধ্যমে ড্যাপ সংশোধনের সুযোগ এখনো আছে।
৭ নভেম্বর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সঙ্গে এক বৈঠকে আশরাফুল ইসলাম এমন অবস্থানের কথা জানান। রাজউকের এমন অবস্থান আগের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ড্যাপের প্রজ্ঞাপনের পর থেকেই এটির সংশোধনের দাবি ও হাইকোর্টে রিট হওয়ার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, রিয়েলটরদের দাবি সঠিক না। ড্যাপের প্রস্তাবনাসমূহের সঠিক বাস্তবায়ন করা হলে এই শহরে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য লক্ষাধিক আবাসিক ইউনিট তৈরি করা সম্ভব হবে দাবি করে তিনি বরাবরই বলছিলেন, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণকাজ করার আন্তরিকতা থাকলে বাস্তবায়ন সহজ হবে।
এনএইচবি/এসএন