বিকল্প কৌশলে নির্বাচনে যেতে মরিয়া জামায়াত!
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মরিয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ জন্য নানা কৌশল খুঁজছে দলটি। দলের নিবন্ধন ফেরত পেতে আইনি লড়াইয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বও দেওয়া হচ্ছে। সম্ভব না হলে ভিন্ন নামে নিবন্ধনের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দলটি। তবে নিবন্ধন পেতে ব্যর্থ হলে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে নিজেদের করে নিয়ে সেই দলের প্রার্থী হওয়ার বিষয়েও আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন জামায়াতের নেতারা। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলোন, নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক বজায় রেখেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে অন্যান্য দলকে পাশে টানছে বিএনপি। তবে আপাতত ২০ দলীয় জোটকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় রাখা হচ্ছে সরকারবিরোধী অন্যান্য দলকে কাছে টানার লক্ষ্যে।
এদিকে, ভোটের মাঠে জামায়াত ইসলামীকে ফ্যাক্টর ধরে গোপনীয়তার সঙ্গেই বিএনপি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দলটির রাজনীতির কৌশল জানতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
জানতে চাইলে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, অধিকাংশ বিরোধী দল যুগপৎ ধারার আন্দোলনের পক্ষে। আমরাও যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করি। এ জন্য জনগণকে নিয়ে আমরাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছি।
তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দলের নিবন্ধনের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। কাজেই আমরাও আইনি প্রক্রিয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে নতুন দল গঠন করছেন। কখনো বলছেন তারা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, আবার কখনো বলা হচ্ছে এটা জামায়াতের নিবন্ধন পাওয়ার বিকল্প কৌশল। আমাদের বক্তব্যে হচ্ছে, যারা নতুন সংগঠন বা দল করছেন তারা কি জামায়াতের রাজনীতি করেন? নাকি দল ছেড়ে নতুন দল গঠন করছেন, এই জবাব একমাত্র তারাই ভালো দিতে পারবেন। অপেক্ষা করুন, সময় হলে আপনারাও জানতে পারবেন।
হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকটি আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দলটির নেতারা।
এদিকে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বিকল্প পথে এগোচ্ছেন। এরই মধ্যে প্রক্রিয়াটি অনেক দূর এগিয়েছে। জানা গেছে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (অলি আহমদ), বাংলাদেশ লেবার পার্টি (ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম) নেতৃত্বাধীন দলগুলোর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলছেন জামায়াতের নেতারা। যদিও জামায়াতের সঙ্গে নিজেদের সখ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, আমাদের দলে জামায়াতের পুনর্বাসনের কোন সুযোগ নেই। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের দায় বহন করব না।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ দল নয়। দলের নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে করা মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। অনেকে না বুঝে নতুন দলটি জামায়াতের বলে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার চালাচ্ছে। নতুন দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নতুন দল গড়তে চাইলে ঘোষণা দিয়ে করত জামায়াতে ইসলামী।
এদিকে বিএনপি-জামায়াতের জোট বহাল থাকলেও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। বিজয়ী হয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দলটির তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই প্রেক্ষাপটে অনেকটাই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল জামায়াত। আর সংগঠন হিসেবে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকায় হাইকোর্টের রায় মেনে দলটির নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। যা এখন আদালতে বিচারাধীন।
তবে প্রকাশ্য কর্মসূচি খুব একটা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে বেশ সুসংগঠিত বলে দাবি করছেন জামায়াত নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে নেওয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা বিবেচনার জন্য সংগঠনের মজলিসে শূরার সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর শূরা সদস্যদের অভিমতের ভিত্তিতেই নতুন নামে দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়। অবশ্য ওই কমিটি গঠনের তথ্য গোপন রাখার অভিযোগে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন লন্ডনে অবস্থানরত ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার হন ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ‘জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও মুজিবুর রহমান মঞ্জু। পরে ২০২০ সালের মে মাসে তারা ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি' বা ‘এবি পার্টি' নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এ দলটিও এবার নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। কমিশনে আবেদন জমা দেওয়া জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে আরেকটি দলেও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন। সবশেষ নতুন করে জমা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নেতারাও আগে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দায়িত্বশীল একজন জামায়াত নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত ইস্যূতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী তৎপরতা চলছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচনে যেকোনো উপায়ে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোকে যেমন পাশে চায় বিএনপি; তেমনিভাবে ভিন্ন কৌশলে বিএনপির কাছ থেকে দূরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল।
তিনি বলেন, সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক অবস্থান রয়েছে।
দেশে ধর্মভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল। বারবার সে সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে বিএনপি। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করে তারা ক্ষমতায় আসে। তবে এর পরই এই দুই দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য গড়ে আওয়ামী লীগ। যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের পতন ঘটায়।
এনএইচবি/এমএমএ/