লবণের দাম চড়া, কারণ জানে না বিসিক!
দেশের বাজারে এখন প্রতি কেজি লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকা। অথচ লবণ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি হওয়া লবণের দাম কে বা কারা নির্ধারণ করে সেটা জানে না সরকারের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। দেশে উৎপাদিত লবণের দাম কেন এত বৃদ্ধি পেয়েছে তার কারণও জানে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিক।
চাল-ডাল, তেল, সাবানের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই তরকারিকে সুস্বাদু করা লবণের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বিশেষ করে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ লবণ, কনফিডেন্স, মোল্লা, এসিআই বাজারে যে লবণ বিক্রি করছে তা ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৩৮ টাকা কেজি দরে। আর দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে।
রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপগুলোতে যে বেশি দামে লবণ বিক্রি করা হচ্ছে সেটি ধরা পড়েছে খোদ জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার অভিযানে।
অবশ্য ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপার দেখভাল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাই চাল, চিনি, সয়াবিন তেল, আটা-ময়দা কোম্পানির ব্যাপারে আমরা খতিয়ে দেখছি। কিন্তু লবণ কোম্পানির নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এর দাম কেন বৃদ্ধি করা হয়েছে এটা তারা বলতে পারবে। কারণ লবণ কোম্পানিগুলো লাইসেন্সও বিসিক থেকে নিয়ে থাকে। কাজেই কিছু জানতে হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
লবণের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মাহবুবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা লবণের উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ব্যাপারটা দেখে থাকি। কিন্তু দাম নির্ধারণ করি না। কাদের সঙ্গে আলোচনা করে লবণ কোম্পানিগুলো দাম নির্ধারণ করে তাও জানি না। তবে কিছু দিন আগে তাদের বলা হয়েছিল কোনোক্রমেই যাতে লবণের দাম বৃদ্ধি করা না হয়। কারণ দেশে প্রচুর লবণের চাষ হচ্ছে। তাই লবণের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ দেখি না। আবারও তাদের বলা হবে।’
এদিকে মোহাম্মদপুরের খুচরা মুদি ব্যবসায়ী রুবেলের প্রশ্ন-লবণ দেশে উৎপাদন হয়। শুধু প্রসেসিং ও প্যাকেটের জন্য যা খরচ হয়। সেই লবণের প্রতি কেজির দাম কেন ৩৮ টাকা? এটাও কি ডলারের সঙ্গে যুক্ত, না ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত? অন্য জিনিসের মতো এতো দাম বৃদ্ধি হয় কীভাবে? এমন ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা তো দাম বাড়াতে পারি না। কোম্পানিই তো ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করছে। আর আমরা কাস্টমারের গালি খাচ্ছি। এটা দেখা দরকার সরকারকে। কারণ কয়েক মাস আগে প্রতি কেজি প্যাকেট লবণ ৩৫ টাকার কম বিক্রি করা হতো।
শুধু ওই খুচরা ব্যবসায়ীই যে ক্ষুব্ধ তা না, তার মত অন্য ব্যবসায়ীরা এবং ভোক্তারাও চরমভাবে ক্ষুদ্ধ লবণের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে। রুবেল নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন অভিযোগ করে বলেন, যে যার মতো করে দাম নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের বেতন তো বাড়েনি। এমন কি হয়েছে যে কেজিতে আট থেকে ১০ টাকা বেশি নিতে হবে। এভাবে ভোক্তাদের ঠকানো হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মিনাবাজার, আগুরা, স্বপ্ন সুপারশ, নন্দনসহ বিভিন্ন সুপারশপে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ লবণ ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ৩৮ টাকা কেজি। সেই লবণ তাদের কাছে মেঘনা গ্রুপ বিক্রি করেছে ২৯ টাকা ৬৪ পয়সা। সুপারশপ লাভ করেছে আট টাকা ৩৬ পয়সা বা ২৮ শতাংশ। একইভাবে কনফিডেন্স লবণের কেজি ওই সুপারশপে ২৮ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রি করা হয়েছে। ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৩৮ টাকায়। কেজিতে লাভ করছে সাড়ে ৯ টাকা বা ৩৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
একইভাবে মোল্লা সল্টও বিভিন্ন সুপারশপে ৩১ টাকা ১৬ পয়সা বিক্রি করা হচ্ছে। সেই লবণ ভোক্তারা কিনছেন ৩৮ টাকা কেজি। কেজিতে লাভ করছে ছয় টাকা ৮৪ পয়সা বা ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ। তবে এসিআই একটু কমে অর্থাৎ ৩৩ টাকা ৯ পয়সা বিক্রি করছে সুপারশপে। আর ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ৩৮ টাকা কেজি দরে। কেজিতে বিভিন্ন সুপাশপ লাভ করছে চার টাকা ৯১ পয়সা বা ১৪ দশমিক ৮০ পয়সা। এ ছাড়া বিভিন্ন দোকান থেকে প্রায় সব কোম্পানির লবণ ৩৮ টাকা কেজি দরে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
ফ্রেশ বান্ডের লবণ বেশি দামে বিক্রির ব্যাপারে জানতে মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি অ্যাডভাইজার মো. শফিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে প্রথমে বলেন, এ ব্যাপারে ডেপুটি অ্যাডভাইজার সব কিছু নির্ধারণ করেন। তিনি ভালো বলতে পারবেন। তার ফোন বন্ধ তাই আপনার কাছে চানতে চাওয়া হচ্ছে। তখন তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সুপারশপসহ খুচরা পর্যায়ে যে লবণ বিক্রি করি তার এমআরপি আমরাই নির্ধারণ করে থাকি। তারা সেই দরে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে। লাভের অংশ খুব বেশি না, ২৮ শতাংশ। তা স্বীকার করে তিনি বলেন, হ্যাঁ, অন্য পণ্যের তুলনায় লাভ একটু বেশি। তা বিবেচনা করা হবে।
এসিআইর ব্র্যান্ড ম্যানেজার রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এটা আমি দেখি না। পরে এসিআই লবণ এর ম্যানেজার মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কোম্পানি থেকে লবণের এমআরপি নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সুপারশপের সঙ্গে চুক্তি করে ৩৩ টাকা ৯ পয়সা বিক্রি করি। তারা ৩৮ টাকা কেজি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে। এ ছাড়া ডিলারদের মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতাদের কাছেও লবণ বিক্রি করা হয়। ৩৮ টাকা কেজি বেশি না। তেমনভাবে দাম বৃদ্ধি পায়নি। কারণ ৫ থেকে ৬ মাস আগে ৩৫ টাকা কেজি ছিল। এরপর ম্যাটেরিয়ালসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
এটা তো দেশে উৎপাদন হয়, প্রসেসিং ও প্যাকেটিংয়ের জন্য কি বেশি দাম? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাহিদা বেশি পাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মোল্লা সল্ট ও কনফিডেন্স সল্টের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, চাল, চিনি, আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, মুরগি ও ডিমের দাম বৃদ্ধির কারণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সম্প্রতি বিভিন্ন কারখানার মালিক, ডিলার, পাইকারি ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির নেতাদের ডেকে বৈঠক করেছে। সেখানে এভাবে দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওযা হয়। কিন্তু তারা কোনো যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেশি দাম আদায় করার প্রমাণ পাওয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশও করেছে।
তাদের এই সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন অনুসন্ধান করে দেখে যে, কোনো কারণ ছাড়াই ইউনিলিভার, সিটি, প্রাণ, এসিআই, মেঘনা গ্রুপসহ রশিদ, এরফান চালকল মালিকরা বেশি দাম আদায় করছে ভোক্তাদের কাছে। বাধ্য হয়ে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ওই সব মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। কেউ সঠিত তথ্য দিতে পারছে না। জবাব দিতে সবাই সময় নিচ্ছে।
এনএইচবি/আরএ/