যা থাকছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখায়
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে যুগপৎ আন্দোলনে রূপ দিতে চায় বিএনপি। সে জন্য কৌশল নির্ধারণে সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে আন্দোলন-সংগ্রামের একটা খসড়া রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে দলটি।
খসড়া রূপরেখায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, জুডিশিয়াল ও গণমাধ্যম কমিশন গঠন এবং রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সমন্বয়ের বিষয়টিও তুলে ধরা হচ্ছে।
চলতি মাসের শেষে বা আগামী মাসের প্রথম দিকেই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রূপরেখা ঘোষণা করা হবে এবং বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দেবে দলটি। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে রূপরেখা ধরেই বিএনপি নেতারা আগামীকাল থেকেই নতুন করে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংলাপে বসতে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে যেসব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল তাদের সঙ্গেই আবারও আলোচনায় বসে রূপরেখা চূড়ান্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, সরকার পতনের পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কাঠামো এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার কৌশল,পরবর্তীতে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের বিষয়টিও গুরুত্ত্ব পাচ্ছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখায়।
বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছে, সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশে রেখে যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রামে যেতে একটি কার্যকর রূপরেখা তৈরি করতে হবে। এখন সেই খসড়া রূপরেখা যাচাই-বাছাই, সংযোজন-বিয়োজনের উদ্দ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চলতি মাসেই সরকার বিরোধী অন্যান্য দলগুলো সঙ্গে আলোচনায় তা নির্ধারণ করা হবে।
বিএনপি সূত্র বলছে, বিএনপি সরকারবিরোধী যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে, তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন। সেই আন্দোলনে ২০ দলীয় জোট ছাড়াও সংলাপ করা ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকা কয়েকটি দলের সম্পৃক্ত থাকার ইঙ্গিত দেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি চায়, খসড়া রূপরেখা অনুযায়ী দলগুলোকে নীতিগত ঐক্যের মধ্যে নিয়ে এসে পরবর্তী সময়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কাঠামো এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার কৌশল ঠিক করা হবে। পরে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হবে। বিএনপি মনে করে, আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই নির্ধারিত হবে ‘নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার’ পদ্ধতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পরিস্কার করে বলতে চাই, যুগপৎ আন্দোলন করব এবং আমরা সব রাজনৈতিক দলকে যুগপৎ আন্দোলনের আসার আহ্বান জানাচ্ছি। পরে যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নির্ধারিত হবে।’
অবশ্য সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব জানান, জাতীয় পার্টির সঙ্গে এখনো আমরা ফরমালি কোনো আলাপ-আলোচনা করিনি। তবে যুগপৎ আন্দোলনে সব দলের জন্যই দরজা খোলা আছে। যে কেনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠন যারা এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করবে তাদের নিয়ে আমরা যুগপৎ আন্দোলন করব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আত্মপ্রত্যয় মনোভাব নিয়ে বিভাগীয় শহর পর্যায়ে সমাবেশ করতে যাচ্ছে বিএনপি। সম্প্রতি তৃণমূল পর্যায়ে নানান প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করাকে আগের চেয়ে ইতিবাচক ধরে নিয়েই সমাবেশের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচিতে এগোচ্ছে বিএনপি। যদিও রূপরেখা চূড়ান্ত করণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির প্রতি সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার বিষয়টি।
কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনের আগেই জাতীয় সরকার ইস্যুতে অস্পষ্টতা দেখছে অন্যান্য দলগুলো। বিএনপি চাচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করতে। কিন্তু বিএনপি জোটের বাইরের দলগুলোর বক্তব্যে হলো নির্বাচনের আগেই হতে হবে জাতীয় সরকার গঠন প্রক্রিয়ার রূপরেখা। অথচ বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারি বিরোধী দলগুলো আরও কাছাকাছি আসবে। নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হবে। যা পরবর্তী কালে জাতীয় সরকার গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বিএনপির বাইরে অধিকাংশ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেলে তাদের আচরণ আওয়ামী লীগের মতো হবে না সেটার নিয়শ্চয়তা কী? এরপরও তারা তাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। তারা কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জোট গঠন করতে ইচ্ছুক নয়। ভবিষ্যতে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদেরকে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে কাজ করতে হবে। এ জন্য বিএনপির কাছ থেকে সুষ্পষ্ট ঘোষণা চান। সংবিধানের কিছু ধারা পরিবর্তন করতে হবে, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, দুদক-নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণ করা যাবে না। এরকম আরো বেশ কিছু বিষয়ে শর্তারোপ করা হয়েছে সরকার বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে।
জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আন্দোলন, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে, সেটি হবে মূলত পরিবর্তনের কর্মসূচি। যেখানে সংবিধান, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকারি কর্মকমিশনসহ (পিএসসি) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় আঙ্গিকে সংস্কারের অঙ্গীকার থাকবে। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে এটা করা হচ্ছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘রূপরেখা প্রস্তুত করা হচ্ছে; কিছুদিনের মধ্যে এটা প্রকাশ করা হবে।
জানা গেছে, রূপরেখা চূড়ান্ত করতে বাম ধারার দলগুলো, ইসলামী দলগুলো এবং ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা দলগুলোকে নিয়ে ভবিষ্যত পথ চলার বিষয়ে একাধিক বিকল্প নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিএনপিতে। জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে কিছু দলের আপত্তির কথা উঠে আসায় জোটগত নয়, যুগপৎ আন্দোলনে দলগুলোকে পাশে রাখতে চায় বিএনপি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সরকারের পদত্যাগ চায়, এমন যে কোনো দল যুক্ত হতে পারবে তাদের আন্দোলনে। রূপরেখায় সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হবে।
রূপরেখা তৈরিতে কাজে যুক্ত একজন বিএনপি নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রূপরেখাকে নির্বাচনের আগে এবং পরে দুই ভাগে ভাগ করেছে দলটি। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, জাতীয় সরকার গঠন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয় থাকবে আন্দোলনের রূপরেখায়।
এই রূপরেখার দ্বিতীয়ভাগে জাতীয় সরকার গঠনকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, জুডিশিয়াল ও গণমাধ্যম কমিশন গঠন এবং রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সমন্বয়।
এই নেতা বলেন, রূপরেখা অনুযায়ি মামলা-হামলা হলেও আন্দোলন থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতে অনুমোদনের পর এ মাসের শেষ সপ্তাহে অথবা আগামী মাসের মাঝামাঝি যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরা হতে পারে।
এনএইচবি/এমএমএ/