‘অসহিষ্ণু মাঠ প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দিতে হবে’
সাম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে প্রশাসনের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। সর্বশেষ গত ২৩ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম একটি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে পুরস্কারের ট্রফি ভেঙে ফেলেন। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ইউএনওকে নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়।
এ ছাড়া, চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গমারীর ইউএনও‘র কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একইভাবে বগুড়া সদর উপজেলার ইউএনও সম্প্রতি স্থানীয় উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন কর্মচারীকে মারধর করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
নওগাঁর বদলগাছি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপদস্থ করে আলোচনায় এসেছেন। এ রকম ঘটনা মাঝে মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উঠে আসে।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আলীকদম, বগুড়া সদর ও ভুরুঙ্গামারীর ইউএনও’র বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর দোষী হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এমনটা বলছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এ নিয়ে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিব্রত। তারা মনে করছেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বে অভাব রয়েছে। একইসঙ্গে তারা বলছেন, সব কর্মকর্তার আচার-আচরণ এক রকম না। তবে যত সমস্যাই আসুক না কেন, সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় সমাধান করতে হবে।
প্রশাসনের সাবেক আমলারা মনে করেন, মাঠ প্রশাসনের কেউ কেউ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। এটা মাঠ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তারা বলছেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উত্তেজিত হওয়া উচিত না। তাদের আরও ঠাণ্ডা থাকা উচিত। মানুষের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হঠাৎ করেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠার বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সকলেই অসহিষ্ণু নন। কেউ কেউ হয়ে উঠছেন, যা মাঠ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বলা যায়, আগের তুলনায় অসহিষ্ণুতা বেড়েছে।
ডাকসাইটে এই আমলা বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে কঠোর বার্তা দেওয়ার সময় এসেছে। একই সঙ্গে আইন-বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থাও নিতে হবে। কেউ যেন মনে না করে, জনগণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পার পাওয়া যায়।
আবু আলম শহিদ খান বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদ এবং অন্যান্য আইন-বিধি অনুসরণ করেই সকল গণকর্মচারীকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার রবিবার ঢাকাপ্রকাশক-কে বলেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কোনোভাবেই অ্যাগ্রেসিভ হওয়া উচিত না। তাদের আরও সংযমি (মাইলড) হওয়া উচিত। তাদের বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। মানুষের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত।
তিনি বলেন, মাঠ প্রশাসনে সবাই যে একইরকম আচরণ করে তা কিন্তু ঠিক না। আমি এটার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করি। আমি মনে করি এই সংখ্যা অনুপাতের দিক থেকে খুবই কম। সারাদেশে ৫০০ ইউএনও কাজ করে। সেখানে দুই তিন জনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট আসছে। আমি মনে করি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ব্যবস্থা নেওয়া কি আসলেই হচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সচিব বলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই নেওয়া হচ্ছে।
এসব ঘটনায় প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে কি না- এই প্রশ্নের জবাবে আলি ইমাম মজুমদার বলেন, প্রশাসন চালাতে গিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও অযাচিত। এমন ঘটনা ঘটা উচিত না। এসব ঘটনায় যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে ঠিক আছে।
এদিকে রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন নিজ দপ্তরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমসহ এপিডি উইং ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। মন্ত্রীর দপ্তর সূত্রে ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রী সিনিয়র সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আলীকদমের ঘটনাসহ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে চানা। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট একটা ধারণা পেতে চেষ্টা করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রতিমন্ত্রীকে বলেছেন, প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে। ভুরুঙ্গামারীতে প্রশ্ন ফাসের ঘটনায় ইউএনওকে মোকজ করা হয়েছে। বগুড়া ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সর্বশেষ আলী কদমের ঘটনার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। প্রতিবেদন হাতে পেলেই সবকিছু জানা যাবে।
আলী কদম উপজেলা ইউএনও’র বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে রবিবার (২৫সেপ্টেম্বর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে কথা বললে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ঘটনাটি এডিসি’র নেতৃত্বে তদন্ত হচ্ছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর দোষী হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, শুধু আলীকদমের ইউএনও নয়, সাম্প্রতি যেসব ইউএনও এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সবগুলো ঘটনাই তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনএইচবি/এমএমএ/