ট্রলি থাকার পরও ভোগান্তি শাহজালালের বিমান যাত্রীদের
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের নিত্য সঙ্গী ভোগান্তি আর হয়রানি যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি লাগেজ বহনে নতুন ট্রলি যুক্ত করলেও সেসব ট্রলি যাত্রীদের কোনো কাজে আসছে না। এখনো দেশের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের লাগেজ মাথায় করে নিয়ে বের হতে হচ্ছে বিমানবন্দর থেকে।
যাত্রীদের অভিযোগ, সেবার মান উন্নয়ন হয়নি। ট্রলি থাকলেও সেগুলো কোনো কাজে আসছে না। কারণ পার্কিং থেকে ট্রলিতে করে লাগেজ বের করা যায় না। বিমানবন্দরে কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও কোনোরকম সহযোগিতা তো দূরের বিষয় ভালো আচরণও পাওয়া যায় না। সরেজমিন বিমাবন্দর এলাকা ঘুরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
অবশ্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, যাত্রীদের অভিযোগ সঠিক না। সেবার মান বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ট্রলির বিষয়ে বিমাবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, অনেক যাত্রী ট্রলি ক্যানেপি থেকে বের করে নিয়ে যত্রতত্র ফেলে রেখে যান। যার ফলে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে।
সরেজমিন শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, বিদেশ থেকে আসা এবং দেশের বাইরে যাওয়া যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ করে লাগেজ বহনে নতুন ট্রলির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও বিদেশ ফেরত যাত্রীরা লাগেজ মাথায় নিয়েই বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে বের হচ্ছেন। এ নিয়ে যাত্রীদের ক্ষোভের কোনো শেষ নেই।
সরেজমিনে বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, বিমানবন্দর পার্কিং (ক্যানোপি) থেকে বের হওয়ার পথের ব্যারিকেড নিয়ে যাত্রীদের বিস্তর অভিযোগ। ভোগান্তি দূর করতে ক্যানোপির ব্যারিকেড তুলে দিয়ে প্রধান ফটক পর্যন্ত ট্রলির ব্যবস্থা করার দাবি জানান যাত্রীরা।
ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে সৌদিআরব থেকে দেশে এসেছেন ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে এসে দুই ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করে লাগেজ পেয়েছি। সেখান থেকে দেখি ট্রলির সংকট। ট্রলি না পেয়ে মাথায় করে মালামাল বাইরে এনেছি এবং গাড়িতে তুলেছি। তিনি প্রশ্ন করে বলেন দেশের বিমানবন্দরে এই ভোগান্তির শেষ কোথায়?
কুয়েত থেকে পাঁচ বছর পর দেশে ফেরা ইমরান আলী বলেন, কুয়েত থেকে এসেছি লাগেজ এবং অন্যান্য ক্লিয়ারেন্স পেতে আমার প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। দেশের মাটিতে যদি এমন ভোগান্তির শিকার হতে হয় সেটা কি মেনে নেওয়া যায়?
সৈয়দ নুরুজ্জামান এসেছেন ব্যাংকক থেকে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এয়ারপোর্টে ট্রলি নেই। কর্তৃপক্ষ কোনো সাহায্য সহযোগিতাও করে না। মালামাল আনতে বিড়ম্বনা এবং ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তারা গেটের বাইরে ট্রলি নিতে দেয় না। কাউকে না পেলে মালামাল আমাদের নিজেদের মাথায় বা টানাহ্যাঁচড়া করে আনতে হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি মাথায় মালামাল নিয়ে গাড়িতে উঠেছি। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ ট্রলি বাইরে আনতে দেয়নি কেন? জবাব চাইলে ভেতরে ডিউটিরত পুলিশ জানান কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, ট্রলি বাইরে নেওয়া যাবে না, আপনার লোকজন এসে লাগেজ নিয়ে যাবে স্যার।’
সৌদি আরবের যাত্রী ফিরোজ হোসেন বলেন, সৌদি থেকে দেশে আসতে যত সময় লেগেছে এয়ারপোর্টের ক্লিয়ারেন্স পেতেও তত সময় লেগেছে। আমাদের এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ তাদের সার্ভিস উন্নত করতে পারেনি। বরং ভোগান্তি বেড়েছে যাত্রীদের।
একইভাবে আরও অনেক যাত্রীর অভিযোগ করেন, এ সব ভোগান্তির কারণে চুরি বা অন্যন্য সমস্যায় পড়ছেন তারা।
অবশ্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্রলির কোনো ভোগান্তি নেই, নতুন ট্রলি এসেছে। এয়ারপোর্টের বাইরে ট্রলি নেওয়া নিষেধ, যার কারণে যাত্রীরা না জেনে অভিযোগ করছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ক্যানোপি-২ দিয়ে হুইল চেয়ার ব্যবহার করা যাত্রীদেরকেও ভোগান্তি নিয়েই গাড়িতে উঠতে হচ্ছে। আবার সারি করে রাখা ট্রলি থেকে লাগেজ মাথায় নিয়ে গাড়িতে তুলতে দেখা গেছে বিদেশ ফেরত অনেক যাত্রীকে।
ট্রলির সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার জিয়াউল হক পলাশ বলেন, এয়ারপোর্টের বাইরে ট্রলি নিয়ে যাওয়া নিষেধ। যাত্রীরা নিজেদের মালামাল নিজেরাই বাইরে নিয়ে যায় এবং গাড়িতে উঠায়। আমরা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করি, যাত্রীদের ভোগান্তি বা অন্যান্য বিষয় আমরা আমলে নিয়েই বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করি। তিনি বলেন, ধরুন কোনো যাত্রীর একটা জিনিস চুরি হলে আমরা সেগুলো উদ্ধারে কাজ করে থাকি। তবে এয়ারপোর্টের ভেতরের পরিবেশটা সম্পূর্ণ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দেখে।
এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফয়সাল বলেন, যাত্রীদের ট্রলি বাইরে নিতে দেয় না সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। দেখা গেছে, অনেক সময় বিমানের যাত্রীরা ট্রলি বাইরে বা রাস্তার উপরে রেখে চলে যায়, সে ক্ষেত্রে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। যার কারণে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। তবে সম্প্রতি বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, বিদেশ ফেরত অনেক যাত্রীদের গাড়ি ভাড়া করার সামর্থ্য নেই। কিংবা কেউ বাসে বা অন্যভাবে তাদের গন্তব্যে যাবেন। কিন্তু তারা সঠিক মতো ট্রলির সার্ভিস না পাওয়ায় তাদের লাগেজ বা বিভিন্ন জিনিস পত্র মাথায় নিয়ে ক্যানোপির ব্যারিকেড পার হতে হচ্ছে।
সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত যাত্রী কালাম বলেন, আমি অসুস্থ হয়ে দেশে ফেরত এসেছি। আমাকে নিতে কেউ আসেনি। মা-বাবাকে বলেছি আমি একাই চলে আসব। বিমান কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দিষ্ট জায়গায় ট্রলি নিতে না দেওয়ায় মালামাল নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, আমার মতো অনেক যাত্রী থাকতে পারে তাদের এমনটা হতে পারে। এ বিষয়টি সমাধান হওয়া উচিত।
দেখা গেছে, বিমানবন্দরে বের হওয়ার পথে কার পার্কিং পর্যন্ত ট্রলি ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হলেও সে পথ ব্যবহার হয় খুবই কম। বিশ্বের অন্য কোনো বিমানবন্দরে ট্রলি ব্যবহারের বাঁধা পেতে হয় না বলে অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।
বিদেশ ফেরত যাত্রীরা জানান, অবিলম্বে বিমানবন্দর এলাকাতে শাটল বাস সার্ভিস কিংবা বিকল্প কোনো পরিবহন ব্যবস্থা চালু করলে দেশে আসা লোকজনের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, দেখা গেছে যাত্রীরা ট্রলি নিয়ে বাইরে যায় এবং সেখানেই ট্রলি ফেলে দেয়। যেখানে সেখানে ট্রলি ফেলে দেওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে ট্রলি ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। অনেক যাত্রী হয়ত ট্রলি বা অন্যান্য বিষয়ে অবগত নয় এজন্য তারা বিভিন্ন অভিযোগ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি যাত্রীদের কথা চিন্তা করে চেয়ারম্যান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এখানে শাটল বাসের ব্যবস্থার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ক্যানোপিগুলো থেকে সংলগ্ন বিমানবন্দরে বা কাছের রেল স্টেশনে এই সার্ভিসটি যাবে। তিনি বলেন, আশা করছি খুব শিগগিরই বাসের সার্ভিস চালুর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে।
এনএইচবি/আরএ/