প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আমলে নিচ্ছে না মন্ত্রণালয়
উন্নয়ন কাজে ধীর গতি
সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন ও সংশোধন নিয়মে কোনো প্রকল্প চতুর্থবার সংশোধনের বিধান নেই। তা স্বত্ত্বেও আশ্রয়ন-২ প্রকল্পটি চতুর্থবারের মতো সংশোধন এর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বরাদ্দ বাড়ছে ৬ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এছাড়া আরও ৬ প্রকল্প সংশোধনের অনুমোদনের জন্য আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে।
জানা গেছে, আগামী একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য ১০টি প্রকল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে। এরমধ্যে মাত্র তিনটি প্রকল্প নতুন। আর সংশোধনের জন্য রয়েছে সাতটি প্রকল্প।
এধরণের উন্নয়নমূলক অসংখ্য প্রকল্পের একই দশা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের টেকসই উন্নয়নে সঠিক সময়ে ও মান বজায় রাখতে প্রায় এক দশকে একনেক সভায় ৭৩২টি অনুশাসন দিয়েছেন। এসব অনুশাসনকে অর্ডার বলা হয়। যা অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তা পালন করছে না। এতে নির্ধারিত সময়ে প্রায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ জন্য প্রতি অর্থবছরে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে। চাপও বাড়ছে বাজেটে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জুলাই মাসে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এক হাজার ১৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নে অনুমোদন দেয় সরকার। পরবর্তীতে দুই দফা সংশেঅধনের পর ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা বলা হয়। কিন্তু তাও হচ্ছে না। এবার সময় বাড়ছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এতে নতুন করে ব্যয় ৬ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা বেড়ে হচ্ছে ১১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
এই আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পটি নেয়া হয় ৭০০টি আশ্রয়ণ গ্রাম স্থাপন করে ৫০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী তিনবারের বেশি কোনো প্রকল্প সংশোধন করা যাবে না। তবে বিশেষ কারণে কোনো মন্ত্রণালয় কোনো বিশেষ সংশোধনের প্রস্তাব করলে পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে তা প্রক্রিয়া করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনার কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়।
আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করেই ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা সদরে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। যা ২০১৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু চারবার সংশোধন করে গত জুনেও শেষ হয়নি। আবারও দুই বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ৭৩২ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
এদিকে গত ৭ ডিসেম্বর একনেক সভায় জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের আইসিটি অবকাঠামো, মানব সম্পদ ও প্রযুক্তি দক্ষতা উন্নয়ন নামে প্রকল্পটি তৃতীয়বার সংশোধন করা হয়েছে। ব্যয় ৪৬ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় ৭১ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তিন বছর সময় বাড়ানো হয়েছে অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের পরিবর্তে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।
সূত্র জানায়, গত ৭ ডিসেম্বর ‘প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পটি প্রথমবারের মতো সংশোধন করা হয়েছে। তাতে ব্যয় ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। সময় বাড়ানো হয়েছে সাড়ে চার বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুনে শুরু হয়ে ২০১৯ সালে পর্যন্ত। কিন্তু এবার ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৩ নভেম্বর রুরাল ট্রান্সপোর্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-২ তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যা ২০১২ সালের জুলাই শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুনে শেষ হবার কথা। কিন্তু সময় ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তিন হাজার ৩৪৩ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাইশটেকি, সাংবাদিক কলোনী ও কুর্মিটোলা খালে ভূমি অধিগ্রহণ এবং খনন/পুনখনন প্রকল্পটিরও একই দশা। ২০১৮ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে ২০১৯ সালে শেষ হবার কথা। কিন্তু দুইবার সংশোধন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় ধরা হয়েছে। ব্যয় বেড়ে ৬০৭ কোটি টাকা থেকে ৬৭০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশ-বিদেশে যোগাযোগের সেতুবন্ধন স্থাপনে সাসেক-১ নামে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক ৪ লেন মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পটিও কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণ প্রকল্পটিও একই পথে। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে চলতি অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি। এটিসহ ৪১৫টি প্রকল্প চলতি অর্থবছরে সম্ভাব্য সমাপ্ত তালিকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কারণ এই তালিকার অনেক প্রকল্প ইতিমধ্যে সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে জমা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে প্রতি অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে বেশি করে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছেন। তা বাড়তে বাড়তে চলতি অর্থবছরে এক হাজার ৫৩৪টি প্রকল্পের বিপরীতে প্রায় দুই লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বারবার প্রকল্প সংশোধন কেন? জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে জনগণের মতো আমরাও চিন্তিত। আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশনা দিচ্ছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে।’
সম্প্রতি একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও নির্দেশনা দিয়েছেন, মান ঠিক রেখে সঠিক সময়ে কাজ করতে হবে বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর ৭৩২ অনুশাসন:
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জনস্বার্থ এবং উন্নয়ন কাজ পরিচালনায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদনের সময় বিভিন্ন অনুশাসন দিয়েছেন। এরমধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫৩টি। এভাবে প্রতি অর্থবছরে অনুশাসন দেন শেখ হাসিনা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫৭টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৬টি এবং ২০-২১ অর্থবছরে ১৫১টি অনুশাসন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এডিপিতে রেকর্ড বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন:
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উন্নয়ন কাজে গত বছরে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ে। তাই চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সরকার ফ্রাষ্টট্র্যাকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের গতি বাড়াতে বেশি করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার দুই লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এমধ্যে বিদেশি ঋণ হচ্ছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে।
এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতির জন্য উদ্যোগ নিলেও তাতে গতি পাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৪৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ১৯ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
জেডএ/জেডএকে