ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকের সিদ্ধান্তে বিএনপির আন্দোলনের রোডম্যাপ
বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন তো বটে, আর কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না বিএনপি। দলটির হাইকমান্ড মনে করছে, এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া তাদের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া। আর কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপিকে ঘিরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানান ছক আঁকা হচ্ছে-হবে। ছক অনুযায়ী একেক সময় একেক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করা হবে। এ ছক বাস্তবায়নের নেতৃত্বে থাকবে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো তাদের তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন। ফলে সব অপকৌশল মোকাবিলা করেই বিএনপিকে সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে হবে।
দলীয় নেতারা মনে করেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকার পতনের আন্দোলন তরান্বিত করতে হবে। এ সরকারের পতন না ঘটিয়ে কোনো সমঝোতা নয়। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না, এটাই বিএনপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। বরং কীভাবে এ সরকারকে বিদায় করা যায় তা নিয়ে জোরালোভাবে কাজ চলছে তারা বলছেন, আগামী নির্বাচন হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে।
স্থায়ী কমিটির সংশ্লিষ্ট নেতাদের মতে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকার পতনের দাবিকে রাজপথের আন্দোলনে রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু করে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। অভিষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। একইসঙ্গে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে আরও কিছুদিন সময় নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বন্যার কারণে বন্ধ থাকা দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম ফের শুরু করারও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে বোঝাপড়ার পর্ব শেষ করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আর ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অংশ না নেওয়া।
এদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের করণীয় ঠিক করতে শীর্ষ নেতাদের মতামত নেওয়া শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। গত রবিবার এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভার্চুয়ালি আলাদা আলাদাভাবে মতামত শুনছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ধারাবাহিকভাবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা সিনিয়র নেতাদের মতামত নেবেন তিনি। দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দলের পুরোপুরি নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান। যিনি গত প্রায় দেড় দশক ধরে লন্ডনে পলাতক। দল পুনর্গঠন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনিই শেষ কথা। তবে তাকে মতামত ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন দলটির স্থায়ী কমিটির নেতারা।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা আশাবাদী খুব শিগগরিই সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি-সংগঠনের মধ্যে একটা ঐকমত্য তৈরি হবে। এ সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, তাদের পদত্যাগ করতে হবে, এই দাবিতেই যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ফের বিভিন্ন আলোচনা শুরু হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদের মতো আগামী নির্বাচনেও ৭০/৮০ সংসদীয় আসন সমঝোতায় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপির একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এবার তারেক রহমান কৌশলে এ বিষয়ে কোন নেতার কী মনোভাব তা জেনে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে তিনি ওয়ান টু ওয়ান কথা বলেছেন। এ নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে জোরালো মত দেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির এমন একজন নেতা তার ঘনিষ্ঠদের বলেছেন- তিনি তারেক রহমানকে বলেছেন- দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে নানান কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। গত নির্বাচনের মতো বিএনপিকে কীভাবে আগামী নির্বাচনে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে তারা নাকি বিভিন্ন স্থানে বৈঠকও করছেন। যদিও সেই আলোচনায় খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়েও কথা হচ্ছে। জবাবে ওই নেতাকে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না, এটাই হচ্ছে দলের সিদ্ধান্ত। বরং সরকার পতনের আন্দোলন কীভাবে আরও জোরালো করা যায় তা নিয়ে কাজ হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যান।
বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সিনিয়র নেতাদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে তারেক রহমান দুটি কাজ করতে চাচ্ছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার মতামত নেওয়া এবং দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়া নেতাদের রাজনীতিতে সক্রিয় করা। বিশেষ করে দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গে যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে প্রয়োজনে তাদেরও দলের পক্ষে কাজে লাগানো যায় কি না- সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় দপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছেন তারেক রহমান।
জানতে চাইলে বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব (দপ্তর চলতি দায়িত্ব) রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএনপির রাজনীতি করতে হলে অবশ্য দলের শৃঙ্খলা মানতে হবে। গঠনতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম করলে দলীয়ভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। তবে সংশ্লিষ্টরা যদি তাদের ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় দলে ফিরে আসতে চায় সেক্ষেত্রে বিবেচনার দায়িত্ব নেওয়ার এখতিয়ার শুধু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনের জন্য বিএনপির আলাদা করে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কথাটা হচ্ছে কোন নির্বাচন, কার অধীনে নির্বাচন? নির্বাচন নিয়ে নয়, বিএনপির চিন্তা একটাই সেটা হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর এ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। এ লক্ষ্যে বিএনপির আন্দোলন চলমান। তবে এটা যথেষ্ট নয়, আন্দোলন বেগবান করতে হবে। প্রত্যাশা করছি, আমরা শিগগিরই যথাযথ আন্দোলন কর্মসূচি উপস্থাপন করতে সক্ষম হব।
অবশ্য ১৬ জুলাই রাজধানীতে একটি বিক্ষোভ সমাবেশে স্থায়ী কমিটির এ নেতা বলেছিলেন- ‘নির্বাচনে যেতে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করছে না বিএনপি। এ সরকারকে কীভাবে বিদায় করা যায় বিএনপি সেই ইশতেহার তৈরি করছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে যারা নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে বলছেন আমি বলব তারা নাস্তিক। আল্লাহর উপর তাদের কোনো বিশ্বাস নেই।’
এদিকে টিভিসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুষ্ঠিত টকশোতে অংশ নেওয়া বিএনপিপন্থী নানা পেশার মানুষ ও দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তথ্য উপাত্ত দিয়ে সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতি তুলে ধরার জন্য তাদের তাগিদ দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে অংশ নেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবদীন, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, আহমেদ আযম খান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি বরাবরই বলে আসছে দলীয় সরকারের বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কখনো কোনো কমিশন নিরপেক্ষ অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে না। একমাত্র নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চলমান সংকট উত্তরণে একমাত্র পথ। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। প্রমাণিত হয়েছে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কতটা ক্ষমতাহীন। আর সে কারণেই বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে।
এনএইচবি/এসএন