সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যোজন যোজন পিছিয়ে বাংলাদেশ
সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশি ভারত ও মিয়ানমার থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আধুনিক ইকুইপমেন্টের অভাবে দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স কোন অনুসন্ধান চালাতে পারছে না। যার ফলে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও দীর্ঘ ১০ বছরেও অনুসন্ধান সেভাবে শুরুই করেনি বাংলাদেশ।
অথচ এই সময়ের মধ্যে মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে এবং গ্যাসের সন্ধানও পেয়েছে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমার ইতিমধ্যে গ্যাস উত্তোলনও শুরু করেছে।
ভারতও তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেছে। একটি ব্লকে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধানও পেয়েছে দেশটি। ভারতের আশা, ২০২৩ সালেই তারা ওই ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করতে পারবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও গ্যাসের সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশকে এখন চাহিদা পূরণে উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলছেন, পুরো আমদানি নির্ভর হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশে জ্বালানি খাত। বাংলাদেশকে অবিলম্বে গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ শুরু করতে হবে। ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপর মিয়ানমার তাদের সীমায় জোরালো অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার করেছে।
অনুসন্ধানের পূর্বাপর
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি উভয় দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। এই রায়ের আগে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারত স্ব স্ব সমুদ্রসীমার কাছাকাছি তেল গ্যাস অনুসন্ধান সংক্রান্ত বিরোধে লিপ্ত ছিল।
বিরোধ নিষ্পত্তির পর থেকে ভারত ও মিয়ানমার তাদের অফশোর ব্লকে দক্ষ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারীদের সম্পৃক্ত করে সক্রিয় কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তারা সফলতাও পেয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ যেকোন অফশোর অনুসন্ধান কর্মসূচিতে উদ্যোগী হওয়ার ক্ষেত্রে ধীর এবং কম সক্রিয় ছিল। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এখন বিশ্বাস করা হয় যে সমুদ্রসীমায় তিন দেশের সমস্ত অফশোর ব্লকগুলো সম্ভাব্য তেল এবং গ্যাস কাঠামো ধারণ করে।
পেট্রোলিয়াম পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সীমানার উভয় পাশে একটি একক গ্যাস আবিষ্কার হলে, যে দেশ প্রথমে সেখানে খনন করবে তারা এটি থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি দেরিতেও গ্যাস পায় তাহলে ভারত-মিয়ানমারের তুলনায় কম লাভবান হবে।
২০১২ সালে ঘোষিত বাংলাদেশ বিডিং রাউন্ডটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি) থেকে শুধু উষ্ণ প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। বাংলাদেশ তখন ১১টি অফশোর ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল।
২০১৪ সালে শুধুমাত্র ৩টি অগভীর সমুদ্র ব্লক আইওসি’কে দেওয়া হয়েছিল এবং গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোর জন্য কোনও কোম্পানি পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত তেল জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর কোনটাই আবেদন করেনি।
আইওসি প্রতিনিধিদের মতে, অফশোরে অনুসন্ধানের জন্য আইওসিগুলোর জন্য প্রণোদনা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। গ্যাসের দাম নিয়ে আইওসি এবং সরকারের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন অববাহিকায় শ্বে, শোয়ে ফু এবং মিয়া গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে কোরিয়ান দাউই অয়েল এবং ভারতীয় ওএনজিসি’র কনসোর্টিয়াম। ভারতও দক্ষিণে অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলে কৃষ্ণ-গোদাবরী অববাহিকায় গ্যাস আবিষ্কার করেছে।
ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন অফশোর অববাহিকা এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অফশোর ব্লকগুলি (টেকনাফ-চট্টগ্রাম উপকূল থেকে) ভূতাত্ত্বিকভাবে একই কাঠামোগত এককের অন্তর্গত যা ভাঁজ বেল্ট নামে পরিচিত। সুতরাং, রাখাইন অববাহিকায় যে ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো বৃহৎ গ্যাস পুল তৈরি করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী অফশোর ব্লকগুলোতেও কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশের অফশোর ব্লক এসএস-৯, এসএস-১০, এসএস-১১ এবং এসএস-১২ গ্যাসের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রাখে। এছাড়াও, অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় অফশোর ব্লকগুলিতে হাইড্রোকার্বন থাকার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের এখন ২৬টি অফশোর ব্লক রয়েছে যার মধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্র এবং ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লক। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর থেকে, বাংলাদেশ আইওসি’র সঙ্গে প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) এর অধীনে মাত্র ৩টি অগভীর সমুদ্র এবং ২টি গভীর সমুদ্র ব্লক সক্রিয় করেছে।
এই ৫টি ব্লক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনোকোফিলিপস, অস্ট্রেলিয়ান স্যান্টোস, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি এবং ভারতীয় ওএনজিসি’র হাতে রয়েছে। এর মধ্যে কনোকোফিলিপসের রয়েছে দুটি ব্লক। এই কোম্পানিটি গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি তোলে এবং বনিবনা না হওয়ায় ২০১৪ সালে চলে যায়।
এখন মাত্র তিনটি অফশোর ব্লক সক্রিয় রয়েছে। ২৩টি ব্লক উন্মুক্ত রয়ে গেছে এখনো। এটি কোন মান দ্বারা একটি যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধান প্রচেষ্টা নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, পেট্রোবাংলার আওতাধীন দেশীয় অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের স্থলভাগে সক্ষমতা থাকলেও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উৎপাদন বিশেষভাবে প্রযুক্তিনির্ভর ও ব্যয়বহুল হওয়ায় সে সক্ষমতা নেই।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বাকি ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার জন্য করোনার আগে দরপত্র আহ্বান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে আবার সেই প্রক্রিয়া পিছিয়েছে।
এগিয়ে ভারত-মিয়ানমার
২০১২ সালে বিরোধ নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার দ্রুত তাদের ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান শুরু করে। ২০১৬ সালেই থালিন-১ গ্যাস ব্লকে গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমার। এই গ্যাসক্ষেত্রে সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ রয়েছে। মিয়ানমার এখান থেকে গ্যাাস উত্তোলন শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে এই গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের মুজদ বাড়তে পারে।
বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় সীমায় কৃষ্ণা-গোদাভরি বেসিনে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে। ভারতের সমুদ্রসীমায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কাজ করছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে বলে আশা করছে ভারত।
আরইউ/