চৌদ্দগ্রামের জুয়েলের হাতের অস্ত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক ইউপি চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতার উপর হামলার পর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অপর এক যুবলীগ নেতার ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) বিকালে উপজেলার নালঘর বাজারে এই হামলার ঘটনা ঘটে। অস্ত্র হাতে থাকা ওই ব্যক্তির নাম মনিরুজ্জামান জুয়েল। স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জুয়েল এলাকায় ক্যাডার হিসেবে পরিচিত।
অভিযোগ উঠেছে, বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের নালঘর বাজারে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদারের ওপর হামলা চালায় জুয়েলসহ অন্যরা। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হামলায় শাহজালাল মজুমদার ছাড়াও তার গাড়ি চালক আমজাদ হোসেন আহত হয়েছেন। হামলায় শাহজালাল মজুমদারের ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।
এদিকে হামলার ঘটনার পর অভিযুক্ত মনিরুজ্জামান জুয়েলের হাতে থাকা একটি এমপি-ফাইভ মডেলের মেশিনগানের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যকে ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, মনিরুজ্জামান জুয়েল একই উপজেলার মিয়াবাজারস্থ গ্রীণ ভিউ রেস্টুরেন্টের সামনে মেশিনগানটি একহাতে নিয়ে আরেকহাতে সিগারেট টানছেন। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার সময় তার আরেকটি ছবিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছেন, সেনাবাহিনী বা বিশেষায়িত বাহিনীর ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে একজন সাধারণ মানুষের হাতে আসলো?
ইন্টারনেটের বদৌলতে এবং বিভিন্ন ভিডিও গেমের মাধ্যমে অস্ত্র সম্পর্কিত তথ্য এখন আর অজানা নয়। ভাইরাল হওয়া ছবির আগ্নেয়াস্ত্রটি দেখতে অবিকল জার্মানির হেকলার অ্যান্ড কচ কোম্পানির তৈরি এমপি-ফাইভ-এ-থ্রি মডেলের মত।
কোম্পানির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, এমপি-ফাইভ-এ-থ্রি একটি ৯ মিলিমিটার সাবমেশিনগান (এসএমজি)। এই মডেলটির প্রস্তুতকারক যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যপী এই অস্ত্রের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী সোয়াট।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষায়িত বাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্র ব্যক্তি পর্যায়ে লাইসেন্স দেওয়া হয় কি না? এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নুরুল আনোয়ার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'বাংলাদেশে তিন ধরণের অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান করা হয়, রিভলবার বা পিস্তল; শটগান ও পয়েন্ট টুটু (.২২) বোরের রাইফেল (পাখি শিকার ও স্পোর্টস এর কাজে ব্যবহৃত রাইফেল)। এর বাহিরে যুদ্ধক্ষেত্র বা মিলিটারি ইউজের কোনো অস্ত্রের লাইসেন্স ব্যক্তি পর্যায়ে প্রদান করা হয় না।
একই প্রশ্নের উত্তরে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'বাংলাদেশে ব্যক্তিপর্যায়ে পিস্তল, শটগান ও পয়েন্ট টুটু (.২২) বোরের রাইফেল ছাড়া আর কোনো আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার সুযোগ নেই।'
এদিকে জুয়েলের হাতে থাকা যে অস্ত্রের ছবিটি ভাইরাল হয়েছে সেটি লাইসেন্স করা বলে দাবি করেছেন চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শুভরঞ্জন চাকমা। তিনি বলেন, 'অলরেডি লাইসেন্সের কাগজপত্র আমাদের হাতে চলে এসেছে, আমরা মিলিয়ে দেখেছি অস্ত্রের সাথে লাইসেন্সের কপির মিল আছে। অস্ত্রটি মেশিনগান কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, এটি জার্মানিতে তৈরি একটি অত্যাধুনিক রাইফেল।' লাইসেন্স করা হলেও জনসম্মুখে কেউ এমনভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করতে পারেন কিনা- জানতে চাইলে ওসি আরও বলেন, 'বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবসরপ্রাপ্ত এক উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জানান, ভাইরাল হওয়া অস্ত্রটি দেখতে অবিকল এমপি-ফাইভ এর মত। ছবিতে অস্ত্রের আকৃতি যা বুঝা যাচ্ছে তাতে তা পয়েন্ট টুটু বোরের রাইফেল হবার সম্ভাবনা কম। তবে আসলে অস্ত্রটি সাবমেশিনগান কী না তা জানতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অস্ত্রটি উদ্ধার করে পরীক্ষা করতে হবে।
হেকলার অ্যান্ড কচ কোম্পানির ওয়েবসাইট সূত্রে আরও জানা গেছে, এমপি-ফাইভ সিরিজের একটি পয়েন্ট টুটু বোরের পিস্তল আছে যা দেখতে একই রকম। এই মডেলটিরও প্রস্তুতকারক যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে এর বাজারজাত শুরু হয়। তবে অবিকল দেখতে আরও একটি অস্ত্র রয়েছে যেটি জার্মান স্পোর্টস গান এর তৈরী। সেটির মডেল জিএসজি-৫। জিএসজি কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে এই অস্ত্রটি মূলত শুটিং স্পোর্টস এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হামলার শিকার ইউপি চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে গোলাপনগর গ্রাম থেকে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের দাওয়াত খেয়ে আসার পথে মনিরুজ্জামান জুয়েলের নেতৃত্বে ৭-৮ জন সন্ত্রাসী আমার গাড়ি গতিরোধ করে হামলা চালায়। তাদের সবার হাতেই অস্ত্র ছিলো। এসময় আমি গাড়ি থেকে নেমে দৌঁড়ে নালঘর বাজারের পার্শবর্তী সামাদ মেম্বারের বাড়িতে আশ্রয় নেই। এ সময় সন্ত্রাসীরা আমার প্রাইভেটকারটি ভাঙচুর করে। পরে স্থানীয়রা একত্রিত হলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, মনিরুজ্জামান জুয়েল একজন চিহ্নিত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। সে সবসময় এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরাফেরা করে। এমনকি চায়ের দোকানে চা খেতে বসলেও সে অস্ত্রটি প্রদর্শন করতে থাকে। তার কাছে নিশ্চয়ই আরো অনেক অস্ত্র রয়েছে, এগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন। তার ভয়ে মানুষ আতঙ্কে থাকে। এর আগেও সে কয়েকবার আমার উপর হামলা চালিয়েছে। এর আগে ইউপি নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরেও সে আমার উপর হামলা চালায়। জুয়েল আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কেউ না। কোনো কমিটিতে তার কোনো কোনো পদ-পদবী নাই। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় ওয়ারেন্ট থাকায় গ্রেফতার থেকে বাঁচতে সে যুবলীগের পরিচয় বহন করছে।
শাহজালাল মজুমদারের দাবি, মনিরুজ্জামান জুয়েলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে না।
মনিরুজ্জামান জুয়েলের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমা বলেন, তার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে সে এলাকায় থাকে না, ঢাকায় থাকে। হঠাৎ হঠাৎ এসে আবার চলে যায়। তবে শাহজালাল মজুমদার যে অভিযোগ এনেছেন, তা সঠিক নয়। আমরা জানতে পেরেছি, জুয়েল আগে শাহজালাল মজুমদারের সাথেই চলাফেরা করতেন। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরেই আজকের এই পরিস্থিতি। এছাড়া বৃহস্পতিবারের ঘটনায় এ পর্যন্ত কেউ থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, তার হাতে যে অস্ত্রের ছবিটি ভাইরাল হয়েছে- সেটি লাইসেন্স করা। অলরেডি লাইসেন্সের কাগজপত্র আমাদের হাতে চলে এসেছে, আমরা মিলিয়ে দেখেছি অস্ত্রের সাথে লাইসেন্সের কপির মিল আছে।
বৈধ অস্ত্র দিয়ে কারও উপর হামলার করা যায় কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, আমরা তদন্তে জানতে পেরেছি কালকে (বৃহস্পতিবার) তিনি কোনো অস্ত্রই বের করেননি, ভাইরাল হওয়া ছবিটি আগের। তাদের যখন সখ্য ছিলো, সে সময়ে তোলা ছবিটা কালকে হয়তো শাহজালাল মজুমদার পোস্ট করেছেন। ঘটনার পরপরই আমাদের তদন্ত কর্মকর্তা ত্রি-নাথ সাহা ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন, স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কোনো অস্ত্রই জুয়েল বের করেন নাই।
মনিরুজ্জামান জুয়েলের বিরুদ্ধে একটি চেক ডিজঅনার মামলায় গ্রেফতারী পরোনা রয়েছে উল্লেখ করে শুভরঞ্জন চাকমা বলেন, আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি। আদালতের ওই মামলাটি ছাড়া তার বিরুদ্ধে থানায় আর কোনো মামলা নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে হামলার ঘটনায় আদালতে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন শাহজালাল মজুমদার। শুক্রবার (১৫ জুলাই) দুপুরে শাহজালাল মজুমদার বলেন, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী মনিরুজ্জামান জুয়েল সবসময় অস্ত্র হাতে এলাকায় ঘুরাঘুরি করেন। তার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে; তারপরও রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না। তাই থানা-পুলিশের উপর আমার আস্থা নেই। রবিবার (১৭ জুলাই) আমি কুমিল্লার আদালতে মামলা করব।
অস্ত্রের ছবি ও হামলার সম্পর্কে বক্তব্য জানতে মনিরুজ্জামান জুয়েলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া তার ব্যবহৃত মোবাইফোনও বন্ধ রয়েছে।
এএস/এএজেড