চামড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ক্ষুদ্র-মাঝারি-মৌসুমি ব্যবসায়ীরা
কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তায় আছেন ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। শেষ পর্যন্ত সঠিক দাম পাবেন কি না, সব চামড়া বিক্রি করতে পারবেন কি না- এনিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। যদিও সরকার গত বছরের তুলনায় এবার চামড়ার দাম খানিকটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে। যদিও এখন পর্যন্ত ঢাকায় ১৮ থেকে ২৪ বর্গফুট বা লবণযুক্ত প্রতিটি গরুর চামড়া ৯০০ থেকে ১২০০ টাকায় বেচা-কেনা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে প্রতিটি চামড়া বেচা-বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। গত বছরের চেয়ে এবারে চামড়ার দাম একটু বেশি। তবে সব কিছু নির্ভর করছে ট্যানারি মালিকদের ইচ্ছার উপর।
অবশ্য ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামেই ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনবেন। তারা বলেন, পুঁজি সংকট দূর করতে পারলে অবস্থার উন্নতি হবে। তারা বলছেন, বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) থেকে ১৫৪টি ট্যানারি একযোগে চামড়া কেনা শুরু করেছে। এবার তাদের লক্ষ্য ৯৫ লাখ চামড়া সংগ্রহ করা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
এবারের কোরবানি ঈদের দিন কয়েক আগে সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। যা অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া বর্গফুট ৪৭-৫২ টাকা। গত বছর ট্যানারি মালিকরা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা বর্গফুট কিনেছিলেন। আর ঢাকার বাইরে সারা দেশে ট্যানারি মালিকদের লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৪০ থেকে ৪৪ টাকা দর নির্ধারণ করে দেয় সরকার। গত বছর এই দাম ছিল ৩৩-৩৭ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়ার দর ৩ টাকা বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। যা গত বছর ছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা।
ট্যানারি মালিকরা এ দামে চামড়া কিনতে সম্মতিও প্রকাশ করেন। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বাড়ছে। চামড়া ব্যবসায়ীরাও ঈদের আগে বলেছিলেন, এবার দাম বাড়বে চামড়ার। কারণে দেশে এবার লবণের সংকট নেই। দামও কম। মিলগেটে ১৪ টাকা কেজি এবং খুচরা পর্যায়ে ২০ টাকা কেজি।
এবার চামড়ার দাম কেমন হলো জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্জুন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘গরুর চামড়া ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পিস কেনা হয়েছে। এরমধ্যে একবারে ছোট গরুর ১০০ টাকা ও বড় গরুরর ৫০০ টাকা। তবে মাঝারি গরুর চামড়া গড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পিস কেনা হয়েছে। আর খাসিরটা ১০ থেকে ৩০ টাকা পিস। প্রতি পিস চামড়ায় গড়ে ৫ থেকে ৭ কেজি লবণ লেগেছে, আর কারিগরের মজুরি লেগেছে ২০০ টাকা। এভাবে প্রতি পিস চামড়ার পেছনে লবণ লাগাতে ৩০০ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সেই চামড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। যা গত বছরের চেয়ে বেশি দাম।
চামড়ার দামের ব্যাপারে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া সাতমসজিদ মাদ্রাসার বোর্ডিং ম্যানেজার মো. জাসিম ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ‘এবার চামড়ার দাম একটু বেশি পাওয়া গেছে। প্রতি পিস গরুর চামড়া ৫৯৫ টাকা বিক্রি করা হয়েছে ট্যানারির কাছে। আর খাসির চামড়া ১০ থেকে ২০ টাকা পিস।
ট্যানারি মালিকরা চাইলেই বাড়বে চামড়ার দাম
ট্যানারিতে দাম বাড়লেও কোরবানিদাতারা এবারও দাম পেলেন না কেন? জানতে চাইলে চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির (বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যানোসিয়েশন) সভাপতি আফতাব খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ গত বারের চেয়ে বেশি দামেই এবার কোরবানির চামড়া কেনা হয়েছে। রাজধানীর প্রধান আড়ৎ পোস্তায় চামড়া কম আনা হয়েছে। মাদ্রাসা, এতিমখানা থেকে ১৫৪টির মধ্যে ৫০ থেকে ৬০টি ট্যানারি মালিকরা সরাসরি চামড়া কিনেছে। এ ছাড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও আড়তে চামড়া বিক্রি করেছে বাজার দরে’।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চামড়ার দামের ব্যাপারে কয়েক বছর আমরা একবারে অন্ধকারে ছিলাম। গতবারের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কেনা হচ্ছে। ২৪ বর্গফুটের চামড়া ১২০০ টাকা, ২০ বর্গফুটের ১০০০ ও ১৮ বর্গফুটের চামড়া ৯০০ টাকা পিস বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০০৮/২০১০ সালের মতো ১৩৫ টাকা বর্গফুট বা ৩২০০ থেকে ৩৩০০ টাকা পিস গরুর চামড়া হবে। এভাবে চামড়ার দাম বাড়তে থাকলে আমরা আলোর মুখ দেখতে পাব।’
তিনি বলেন, ‘চামড়ার বাড়তি দাম নির্ভর করছে ট্যানারি মালিকদের উপর। তারা বেশি দাম দিলে আমরাও বেশি দামে চামড়া কিনতে পারব।’
এ চামড়া ব্যবসায়ীর কথার সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ টেনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আগের ঘোষণা অনুযায়ী ট্যানারি মালিকরা বৃহস্পতিবার থেকে কোরবানির চামড়া কেনা শুরু করেছে। সরকারের নির্ধারিত দামেই কেনা হচ্ছে। ঢাকার মধ্যে আড়ত থেকে প্রতি পিস গরুর চামড়া গড়ে ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা পিস কেনা হচ্ছে। আর ঢাকার বাইরে কম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পিস। এটাও সরকারের নির্ধারিত দামে কেনা হচ্ছে।
চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ট্যানারি মালিকরা তৎপর না হলে চামড়ার দাম বাড়বে না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ট্যানারি মালিকরা কোরবানির চামড়া কেনার ব্যাপারে খুবই তৎপর। এ জন্যই আগের বছরের চেয়ে বেশি দামে এবার চামড়া কেনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে দাম। তাই আমরাও বেশি দামে কিনছি। শুধু তাই নয়, এবারে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে সরাসারি ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনেছেন। বিভিন্ন ট্যানারি মালিকরা সাড়ে ৩ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন। ১৫৪টি ট্যানারি রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে একযোগে লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করেছে বৃহস্পতিবার থেকে। এ বছর ট্যানারি মালিকরা ৯৫ লাখ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া খাসির চামড়া সংগ্রহ করবেন।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) কী পরিমাণ কেনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। এ জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।’
আগের মতো দাম বাড়ছে না কেন? সরকার কী করলে বাড়বে দাম। এমন প্রশ্নের জবাবে শাহিন আহমেদ জানান, ‘পুঁজি সংকটসহ বিভিন্ন ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা পেলেই আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কেমিক্যাল প্রয়োজন। সুপারভাইজড বন্ড সুবিধার আওতায় ট্যানারিগুলো কেমিক্যাল সংগ্রহ করে থাকে। তাই ট্যানারি শিল্পের স্বার্থে সুপারভাইজড বন্ড বহাল রাখা ও এর সুবিধার আওতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া চামড়া শিল্প নগরীর সিইটিপির ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে হবে। চামড়া খাতে ঋণের তিন বছরের সুদ মওকুফ, জরুরি ভিত্তিতে পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন, এলডব্লিউজি সনদ অর্জনের পদক্ষেপসহ চামড়া শিল্প নগরীর ভূমি বরাদ্দ নীতিমালা হালনাগাদ করতে হবে। এসব করলে চামড়া শিল্প আগের অবস্থায় আসবে ফিরে।
এনএইচবি/এসএন