এডিটর’স টক অনুষ্ঠানে জিএম কাদের
এরশাদের চেয়ে ছোট স্বৈরাচার কে?
গোলাম মোহম্মদ কাদের জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। পিতা মকবুল হোসেন এবং মা মজিদা খাতুন। পড়াশুনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করলেও পরবর্তীতে রাজনীতিতে চলে আসেন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং চার চারবারের এমপি। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। আজ আমরা তাঁর কাছে থেকেই শুনব তাঁর জীবনের গল্প, রাজনীতির গল্প এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। তার সঙ্গে কথোপকথনের শেষ পর্ব তুলে ধরা হলো।
মোস্তফা কামাল: আপনি প্রশাসনের দলীয়করণের কথা বলেছিলেন। কখন থেকে এটা শুরু হয় এবং এটা এখনও চলছে কি না?
জিএমকাদের: ৯১ থেকে অর্থাৎ এরশাদ সাহেব চলে যাওয়ার পর থেকেই চলছে এবং ব্যাপকভাবেই তা চলছে।
মোস্তফা কামাল: এটা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
জি এম কাদের: এটা থেকে পরিত্রাণের উপায়টা কঠিন হয়ে গেছে। জনগণের রুচির বিষয়টা সংকীর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর্টিকেলও লিখেছি। আমার যেটা মনে হয়, সংবিধানকে কাটছাঁট করে আমরা যেটা করেছি, অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার বিষয়টা সেটা জনগণের পক্ষে নেই। সাংবিধানিকভাবে একনায়কতন্ত্র চালু করা হয়েছে।
মোস্তফা কামাল: তার মানে এখনকার সময়টিকে আপনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে চান না ?
জি এম কাদের: না, আমি বলতে চাই না। আমি এ বিষয়ে লিখেছিও। একনায়কতন্ত্র অথবা রাজতন্ত্র যেটাই আপনি বলেন না কেন এখানে একজনই সকল ক্ষমতার উৎস। তিনি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে, আইনের ঊর্ধ্বে। সারাদেশের লোক জবাবদিহিতার ভিতর থাকলেও তিনি একা বিচার ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে থাকবেন। গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। প্রতিটি লোক আইনের অধীন থাকবে, প্রতিটি লোক জবাবদিহিতার অধীন থাকবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় যত ভাল প্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব হবে গণতান্ত্রিক চর্চা মজবুত হবে। সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা মানে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রবেশদ্বার। সার্বক্ষণিকভাবে প্রতিটি মুহূর্ত জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এটিই হচ্ছে গণতান্ত্রিক চর্চা । জনগণের কাছে সেই জবাবদিহিতাটুকু নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের নির্বাচন কমিশনে গলদ আছে। আমাদের দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ১১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সকল দিক বিবেচনা করে সর্বজনগৃহীত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা এবং ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগকে পরিষ্কারভাবে বলা আছে নির্বাচন কমিশনকে সবরকম সহযোগিতা দানের জন্য। কিন্তু আইনগুলি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তার মানে নির্বাচন ব্যবস্থাকে আমরা সাংবিধানিকভাবেই দুর্বল করে ফেলছি। তারপর যদি আমরা ৭০ অনুচ্ছেদে আসি। যেখানে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হলো জতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী যেকোন চুক্তি করে আসার পরে সেটা সর্বপ্রথম সংসদে উত্থাপন হবে। সেখানে সরকারিদল এমনকি বিরোধীদলের লোকজনও উনার বিরুদ্ধে বলবে। সেখানে জবাবদিহিতার একটি বিষয় থাকবে। ৭০ অনুচ্ছেদ করে জবাবদিহিতার বিষয়টিকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টির প্রধান, কাজেই উনার কথার বাইরে কেউ যেতে পারবে না। উনি যেটি বলবেন সেটাই। তার মানে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উনি কিন্তু জবাবদিহিতার বাইরে চলে যাচ্ছেন। এবার বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে যদি বলি, ১১৬ ধারার কারণে মহামান্য প্রেসিডেন্টও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাতে মূল ক্ষমতাভার সমূহ ন্যস্ত করেন। তাহলে যে ব্যক্তির হাতে সকল ক্ষমতা, জবাবদিহিতার বিষয়টিও তার অধীন, বিচারবিভাগের অধিকাংশ ক্ষমতা তারই আওতাধীন, সেক্ষেত্রে সেই সরকারকে কি করে গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের শাসন বলা যায় না।
মোস্তফা কামাল: এই অবস্থা থেকে বের হওয়া যায় বা উত্তরণের পথ কি?
জি এম কাদের: গণতান্ত্রিক সরকার বলতে যা বোঝায় এবং তাকে যদি আমরা সংসদীয় পদ্ধতির মাধ্যমে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে চাই, তাহলে অন্যান্য দেশে বিশেষ করে ইংল্যান্ড এমনকি ভারতেও যে পদ্ধতি চালু আছে আমরা অনুসরণ করতে পারি। নয়তো একনায়কতন্ত্র ব্যবস্থা তৈরি করে তাকে সংসদীয় ব্যবস্থা বলে চালিয়ে দেয়া এটা আসলে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মোস্তফা কামাল: আপনিতো এরশাদ সরকারের শাসন আমলকে স্বর্ণযুগ বলেছেন। কিন্তু অনেকেই তাকে স্বৈরাচার বলতো, আপনি কি জানেন?
জি এম কাদের: আমি জানি,শুনি। কিন্তু আসলে কেন বলেন, সেকথা কেউ কখনও বলতে পারেননি। আমি একটা প্রশ্ন করি, একদম বুকে হাত দিয়ে, বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুনতো, উনার চেয়ে বড় স্বৈরাচার কে জানতে চাচ্ছি না, কিন্তু উনার চেয়ে ছোট স্বৈরাচার কে? একজনের নাম আমাকে বলুনতো! এরকম কেউ বলতে পারেননি। যারা বলবেন তারা বাধ্য হয়ে বলবেন। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে যদি বলেন, কেউই বলতে পারবে না, আমাকে কেউ বলেনি। তাকে স্বৈরাচার বলার একটা কারণ হিসেবে এটুকু বলতে পারি, উনি উনার সময়ে বেশ কিছু কাজ করেছিলেন, যেটা তখন বিরোধীদলে যারা ছিলেন, তারা পছন্দ করেনি। কিন্তু জনগণ পছন্দ করেছিল।
মোস্তফা কামাল: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যমেরও একটি ভুমিকা থাকে। আপনি কি মনে করেন যে, মিডিয়া সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে ভূমিকা পালন করছে?
জি এম কাদের: হ্যাঁ, আমি একটা জিনিস স্যালুট করি তাদেরকে যে, বাংলাদেশের মিডিয়া অন্তত চেষ্টা করে যাচ্ছে । আমার কাছে মনে হয় মিডিয়া অনেক সরব এবং তারা চেষ্টা করছে। দেশ জাতির স্বার্থে তাদের প্রচেস্টা আছে। তবে মিডিয়াকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সত্যপ্রকাশে দ্বিধাহীন হতে হবে। মিডিয়ার নিজস্ব সংঘটনগুলিকেও অকেজো করে দেয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কলুষতা পরিলক্ষিত হলেও তবুও আমি বলবো অন্যন্য ক্ষেত্র থেকে মিডিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এর চেয়ে আরও বেশি সাহসী ভুমিকা পালন করতে পারতো যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্যটুকু ধরে রাখতে পারতো।
মোস্তফা কামাল: আগের দিকে রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কগুলি সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। এখন সম্পর্কগুলি কেমন মনে হয় আপনার কাছে?
জি এম কাদের: আছে। আমি মনে করি সম্পর্কগুলি এখনও ভাল আছে। সঠিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে এলে যেটুকু ফাটল দেখছি সেটিও ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়। মানুষ কিন্তু বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হিসেবে চিন্তা করে এবং মানুষের এই চিন্তাগুলি নেতিবাচক। তারা আসলে দুইদল থেকেই মুখ ফিরিয়ে আসলে তারা বিকল্প কোন পথ খুঁজছে।
মোস্তফা কামাল: দেশে নানা ধরনের অন্যায় অপকর্ম দুর্নীতিগুলি যেগুলো হচ্ছে, কারও কোন দায়বদ্ধতা নেই যেন এটাই স্বাভাবিক। এই যে একটা অবস্থা আপনি কি মনে করেন যে, এই সমাজ ব্যবস্থাটি ঠিক আছে অথবা এর পরিবর্তন দরকার?
জি এম কাদের: এটি তো মোটেই ঠিক নেই। এটির অবশ্যই পরিবর্তন দরকার এবং পরিবর্তন হবে নিশ্চয়ই এবং হতেই হবে । আমি মনে করি, আমাদের গোঁড়ায় সাংবিধানিকভাবেই কতগুলি ভুল সৃষ্টি করেছি যে কারণে সমাজ ভুলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
মোস্তফা কামাল: এবার একটু ব্যক্তিগত জীবনে যাই। আপনি কি ব্যক্তিজীবনে সুখি?
জি এম কাদের: আসলে সুখ তো রিলেটিভ একটা বিষয় তাইনা? হ্যাঁ, আমি সুখিতো নিশ্চয়ই। তবে অতৃপ্তি থাকবেই। যখন সামাজিক অসংগতিগুলি চোখে পড়ে, সৎ অফিসার এসে বলে যে, সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না তখন দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অতৃপ্তি থেকেই যায়। এরকম অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার আছে।
মোস্তফা কামাল: অবসরে কি করেন?
জি এম কাদের: অবসর খুব একটা পাই না। তবে বই পড়ার প্রতি আমার সবসময়ের আগ্রহ ছিল। তবে এখন কম পড়া হয়।
মোস্তফা কামাল: সিনেমা দেখেন কি?
জি এম কাদের: হ্যাঁ, সিনেমা দেখা হয় মাঝেমাঝে।
মোস্তফা কামাল: গান শোনেন?
জি এম কাদের: হ্যাঁ, গান শুনি। রবীন্দ্রসংগীত শোনা হয় বেশি।
মোস্তফা কামাল: প্রিয় কোন কবি?
জি এম কাদের: জীবনানন্দ দাশ সুকান্ত র কবিতা ভাল লাগতো।
মোস্তফা কামাল: প্রিয় কোন রাজনীতিবিদ?
জি এম কাদের: মৌলানা ভাসানীর কথাই চলে আসে। আমার খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন।
মোস্তফা কামাল: আপনি জীবনে কি হতে চেয়েছিলেন?
জি এম কাদের: ছোটবেলায় পাইলট হতে চেয়েছিলাম।
মোস্তফা কামাল: আপনার না পাওয়ার আক্ষেপ আছে কি না?
জি এম কাদের: না, কোনো আক্ষেপ নাই। আল্লাহ কাছে আমি যা চেয়েছি পেয়েছি। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
মোস্তফা কামাল: ঢাকাপ্রকাশের পাঠকদের প্রতি আপনার শেষ কথাটুকু যদি বলেন?
জি এম কাদের: আমি দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে চাই। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। জনগণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক, সুখি সমৃদ্ধ দেশ দেখুক আগামী প্রজন্ম। আমার সেটাই কামনা সবসময়। সে লক্ষ্যেই জীবনভর কাজ করতে চাই এবং সকলের কাছে আমি সেই দোয়া চাই।
মোস্তফা কামাল: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জি এম কাদের: আপনাকেও ধন্যবাদ।