এডিটর’স টক অনুষ্ঠানে জিএম কাদের
‘মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি’
ঢাকাপ্রকাশের এডিটর’স টক অনুষ্ঠানে প্রধান সম্পাদক মোস্তফা কামালের মুখোমুখি হন জিএম কাদের, এমপি
গোলাম মোহম্মদ কাদের জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। পিতা মকবুল হোসেন এবং মা মজিদা খাতুন। পড়াশুনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করলেও পরবর্তীতে রাজনীতিতে চলে আসেন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং চার চারবারের এমপি। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। আজ আমরা তাঁর কাছে থেকেই শুনব তাঁর জীবনের গল্প, রাজনীতির গল্প এবং আরও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। তার সঙ্গে কথোপকথনের প্রথম পর্ব তুলে ধরা হলো।
মোস্তফা কামাল: জিএম. কাদের, আমরা আপনার শৈশব এবং কৈশোরের সময়কালটা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
জিএম কাদের: শৈশব বা শিশুকাল থেকে আমি রংপুর শহরে মানুষ হয়েছি। আমার জন্মটা লালমনিরহাটে না, দিনহাটা, পশিমবঙ্গের কুচবিহার জেলায়। তবে একেবারে জ্ঞান হওয়া থেকেই আমার বাবা রংপুর শহরে বাড়ি করায় আমরা সেখানেই কাটিয়েছি। তখন শহরটা অনেক ছোট ছিল, গাড়ি ছিল না বললেই চলে। যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল শুধু রিকশা। মহিলারা রিকশা ভ্রমণ করার সময় চারপাশে পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। অর্থাৎ পর্দার বিষয়টি খুব খেয়াল করা হতো তখন। ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গেই পড়াশুনা করতো, তবে খুবই শালীনতার সঙ্গে। সেই সময় জিনিসপাতির দাম খুবই কম ছিল। আমার মনে আছে, মা একবার বাবাকে বলছেন যে, চালের দাম দশ টাকা হয়ে গেছে। মানুষ কিভাবে বাঁচবে! দশ টাকা মণ চাল মানে অনেক বিশাল কিছু।
মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে বেশ আনন্দমুখর পরিবেশে আমরা বড় হয়েছি। আমার বড় ভাই, তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় থাকায় আমাদের আবদার সবকিছুই ছিল তার কাছে। সেই সময় বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা, এটি ছিল এক আনন্দের বিষয়। ভাইয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতাম।
আমার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল একটি গার্লস স্কুল থেকে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা গার্লস স্কুলেই পড়েছি। তারপর জেলা স্কুলে ভর্তি হলাম এবং ১৯৬৩ সালে এসএসসিতে আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। তখন আমার পাড়ার লোকেরা আমাকে দেখতে এসেছিল এবং একটি বিশাল আনন্দ হয়েছিল। এরপর আমি কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হই এবং ১৯৬৫ সালে কলেজ জীবন শেষ করি। তারপর ১৯৬৫ সালে ভর্তি হলাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। এই ছিল আমার শৈশব এবং কৈশোরের ঘটনা। শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বিশেষ করে গ্রামের সবুজ পরিবেশ, পাখির বাসা–তারপর দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করত। এখনও মনে আছে।
মোস্তফা কামাল: বুয়েটের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলেন আমাদের।
জিএম কাদের: বুয়েট থেকে আমি ১৯৬৯ সালে বের হয়েছি। খুবই ডিসিপ্লিন ছিল তখন বুয়েটে। পড়াশুনার পাশাপাশি আনন্দ-উৎসব সবই ছিল। তবে পড়াশুনার বিকল্প কিছুই ভাবতে পারতাম না। পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি হয়ে যেত এবং চাকরির জন্য আগে থেকেই অফার চলে আসত। তারা উৎসাহিত করত যে, তোমরা আমাদের এখানে জয়েন করো। এজন্য সবাই খুব ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করত। তবে এখনকার সময় আর তখনকার সময়ে ব্যাপক পার্থক্য দেখছি। শিক্ষার সেই গুণগত পরিবেশ নেই।
মোস্তফা কামাল: আপনার কথা থেকেই জানতে চাচ্ছি–আপনি তো বললেন যে, পাস করে বেরুলেই আপনারা চাকরি পেতেন আর এখনকার ছাত্রদের মধ্যে শুধুই হতাশা। দেশে বেকার সমস্যা প্রকট–এ বিষয়ে কিছু বলেন।
জিএম কাদের: এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ তরুণরা জাতির ভবিষ্যৎ। তা ছাড়া আমাদের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগই তরুণ। তারাই দেশের ভবিষ্যৎ, মূল চালিকাশক্তি। তারা পড়াশুনা করে মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে না জীবন-যাপনের মান উন্নয়ন করতে পারবে না–এগুলো খুবই দুঃখজনক। তাদের নিয়ে আমাদের সুগভীরভাবে ভাবতে হবে। তরুণদের জন্য সঠিক পথ তৈরি করে দিতে না পারলে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে না।
মোস্তফা কামাল: আপনি তো দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন, তাহলে রাজনীতিতে কেন এলেন?
জিএম কাদের: আমি যে রাজনীতি করব বা রাজনীতিতে আসব–এটা কোনো সময়ই স্বপ্ন বা কল্পনাতেও ছিল না। আমার ভাই রাজনীতিতে ছিলেন। হঠাৎ করে ১৯৯০ সালে যখন তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো, তখন আমি আর থাকতে পারিনি। একরকম বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে আসা। আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। আমি কিন্তু কোনো রাজনৈতির সুবিধা নেইনি। আমি প্রফেশনাল লোক এবং আমি প্রফেশনাল হিসেবেই কাজ করেছি; কিন্তু ওই সময়ে আমাকে ওএসডি করে দিয়েছিল এবং আমার গাড়ি এবং অন্যান্য সুবিধাগুলো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। আমি একটা দু্রূহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটিয়েছি।
যা-ই হোক, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আমি লালমনিরহাট থেকে জয়লাভ করলাম। সাধারণ জনগণ হয়তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সমর্থক; কিন্তু তারা বলেছে, আমরা আপনাকেই ভোট দেব, এটা অবশ্য আমার ভাইয়ের জন্য। আবার অনেকেই বলেছে যে, উনাকে আমাদের ভালো লেগেছে তাই। ভালো লেগেছে শুনে আমার মন একেবারে ভরে গিয়েছে।
নির্বাচনের আগে আমাকে বড় ধরনের সহযোগিতা করেছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভাই। তিনি বলেছেন যে, জিএম কাদেরকে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ দিলে দলের জন্য খুবই উপকার হবে। ইলেকশনের পর আমাকে প্রেসিডিয়াম পদ দেওয়া হয়। আমার পক্ষে আরও কাজ করেছে মিডিয়া, বিশেষ করে টেলিভিশন। আমি একটা টক শো করতাম। সংসদ থেকে আমাদের একটা ট্রেনিং দিয়েছিল, এটা আমার জন্য খুবই কাজ করেছে। টকশোতে গিয়ে আমি আল্লাহর রহমতে জনগণের কাছে খুবই পরিচিত হয়ে গেলাম। এটা হলো প্রথমত, আমার ভাইয়ের কারণে আর দুই নম্বর হলো–টক শোর কারণে দেশের লোক আমার কথা শুনেছে, আমার চেহারা দেখেছে, এতেই আমার লাভ হয়েছে এবং আমি সত্যিই সাধারণ মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি–মানুষ আমার হাত ধরে আমার সান্নিধ্যে এসে নির্ভরতা পেয়েছে। এই যে ‘ভালো মানুষ’ একটা খেতাব–আমি মানুষের কাছে পেয়েছি–সেজন্য আমি তাদের কাছে সবসময় কৃতজ্ঞতা জানাই।
মোস্তফা কামাল: দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতি জীবনে, প্রায় ২৫ বছর, এর মধ্যে আপনার নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন কী একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে?
জিএম কাদের: দেশের ভালো করার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করা দরকার, তা আমি করেছি এবং করে যাচ্ছি। আমার ধারণা–রাজনীতিতে পাওয়ার কিছুই নেই। দেশের সম্পদ পাওয়ার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত নয়। আমার পাওয়ার জিনিস হলো জনগণের ভালোবাসা এবং সেটা পাওয়ার জন্য আমি সবসময়ই চেষ্টা করছি।
মোস্তফা কামাল: খুবই চমৎকার। আরও একটি প্রশ্ন, সেটা হলো–আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, মন্ত্রী-মিনিস্টার হলেই তারা রাতারাতি বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। গাড়ি, বাড়ি এমনকি কোনো কিছুরই অভাব থাকে না। আপনার কী মনে হয়–মনে হয় না যে, রাজনীতি কুলষিত হয়ে গেছে বা এই রাজনীতির পরিবর্তন হওয়া দরকার?
জিএম কাদের: হ্যাঁ, এটা আমি সবসময়ই বলি। রাজনীতি অবশ্যই কুলষিত হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে। যার জন্য অনেকেই বলে যে, ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে; কিন্তু রাজনীতির অর্থই হলো–ক্ষমতার জন্য রাজনীতি। ক্ষমতা ছাড়া রাজনীতি করে কোনো ফয়দা লাভ করা যায় না। ক্ষমতা কেন চাই, কারণ ক্ষমতায় গেলে আমি দেশ এবং জনগণের জন্য ভালো কাজ করতে পারব। মানে, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আমি দেশ ও জনগণের জন্য ভালো কাজ করতে পারব। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত কাজ করলে সেটাকে বলা হয় ক্ষমতার অপব্যবহার। এবং এই ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্যই জনগণ বলে দেশের রাজনীতি কুলষিত হচ্ছে। এই অপব্যবহারের জন্যই রাজনীতিবিদদের উপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার জন্য রাজনীতিবিদদের বলা হয় ক্ষমতালোভী।
মোস্তফা কামাল: আপনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, আপনার দ্বারা কি কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো কাজ হয়েছে বা আপনি করেছেন?
জিএম কাদের: আমার উপর একটি এলিগেশন এটাই ছিল যে, আমি এটা করিনি। আপনি তো রাজনীতিবিদ, কাজেই আপনি তো আপনার ভবিষ্যতের পজিশন ভালো করার জন্য জনগণকে বা আপনার দলের লোকদের সুযোগ-সুবিধা দেবেন। তা হলেই তো জনগণ বা দলের লোকজন ভবিষ্যতে আপনাকে বারবার এমপি পদে রায় দেবেন। যারা সমাজকর্মী বা সমাজের জন্য কাজ করতে চায়,তাদের জন্য একটি গণ্ডির ভেতর কাজ করতে হবে এবং ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে। ক্ষমতালোভী হলে চলবে না এবং অপব্যবহার করা যাবে না। আমি রাজনীতির ক্ষমতাটুকু যতটুকু সম্ভব কাজে লাগাতে চেয়েছি; কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার কখনও করিনি। আমার শত্রু বা যারা আমাকে অপছন্দ করে, তারাও কিন্তু এ কথাটি স্বীকার করে।
মোস্তফা কামাল: আচ্ছা, আপনি এরশাদ সাহেবের ভাই। সেই পরিচয় বাদ দিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, এরশাদ সাহেবের ৯ বছর শাসন আমলের কথা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
জিএম কাদের: এরশাদ সাহেব আমার ভাই সেদিক বিবেচনা করে বলছি না। নিরপেক্ষভাবে যদি বলি, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে যা করে গেছেন তার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো শাসন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কাঠামোগত উন্নয়নও তিনি করে দিয়ে গেছেন। উনি সংস্কারমূলক অনেক কাজ করেছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার খুবই বড় একটা উন্নতি করেছেন। ঔষধ শিল্প, চামড়া শিল্প এবং গার্মেন্টস শিল্পসহ অনেক জনসেবামূলক কার্যক্রম চালু করেছিলেন। যার জন্য জনগণ এখন অনেক সুফল অর্জন করছেন। তার চেষ্টাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
এসএ/