আওয়ামী লীগের বিকল্প ভাবছে জাতীয় পার্টি
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চায় না। দলটির শীর্ষ নেতারা বিকল্প ভাবার জন্য দলীয় নেতৃত্বকে চাপ দিচ্ছেন।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টির নেতারা যতই হুঙ্কার দিন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থান ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কারণ তারা মূলত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। তাছাড়া গত ৩২ বছরে জাতীয় পার্টি মাঠপর্যায়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। তার উপর নেতৃত্ব নিয়ে আবার দলে অভ্যন্তরে রয়েছে বহুমুখী সংকট। সব কিছু মিলিয়ে দলটিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার অবসান ঘটে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। এরপর আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে পারেননি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বা তার হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি। তবে সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতায় না থাকলেও ক্ষমতার ছায়ায় থেকেছে কয়েক দফা।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতার সাধ নিচ্ছে দলটি। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি সংসদের প্রধান বিরোধী দল।
গত প্রায় ১৩ বছর ধরে সরকারে এবং সংসদের বিরোধী দলে থেকেও মাঠপর্যায়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পারেনি বা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। এমনকি পর পর দুই বার সুযোগ পেয়েও সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে পারেনি দলটি।
২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নবম সংসদে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ২৪টি। ওই সংসদে বিএনপির আসন ছিল ২২টি।
নবম সংসদে জাতীয় পার্টি ছিল প্রধান বিরোধী দল। একই সঙ্গে মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও প্রতিনিধিত্ব ছিল দলটির।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকষাকষি করেও জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১টি। অর্থাৎ নবম সংসদের তুলনায় আসন বেড়েছিল মাত্র পাঁচটি। কিন্তু একাদশ সংসদে গিয়ে ১১টি আসন কমে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২০টিতে। এ নিয়েই দলটি সংসদের প্রধান বিরোধী দল।
আর একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাঝপথে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো বিএনপির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে মাত্র ৬টি।
সংসদ নির্বাচনের এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে মাঠের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির অবস্থান কতটা শক্তিশালী। অথচ সর্বশেষ তিনটি সংসদেই জাতীয় পার্টি ছিল সংসদে প্রধান বিরোধী দল এবং প্রথম দুই বার সরকারের অংশীদার। তারপরও মাঠপর্যায়ে যেমন দলকে শক্তিশালী করতে পারেনি, তেমনি সংসদে দলের প্রতিনিধিত্বও বাড়াতে পারেনি স্বৈরশাসক এরশাদের হাতে গড়া দলটি।
বর্তমানে নানাভাগে বিভক্ত জাতীয় পার্টি। এত বিভক্তির মধ্যেও এখনও পার্টিতে ঐক্য নেই, নানামুখী সংকট চলছে। এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের বর্তমানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। আর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হচ্ছেন রওশন এরশাদ। অর্থাৎ পার্টির নেতৃত্বে জি এম কাদের থাকলেও পার্টিতে যে অনৈক্য বিরাজ করছে সেটা স্পষ্ট।
অপরদিকে, জি এম কাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি মামলা করেছেন মূল জাতীয় পার্টির দাবিদার এরশাদ পত্নী বিদিশা এরশাদ।
নানা সংকটে জাতীয় পার্টির যখন ত্রাহি অবস্থা তখন আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে হুংকার দিচ্ছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। তারা বিভিন্ন সময় বলে আসছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর নির্বাচনী জোট করবেন না। এমনও বলেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারাই জোট করেছে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। তাই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিকল্প ভাবার কথা বলছেন দলের সিনিয়র নেতারা।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে এত খাতির করলাম, তিন বার চারবার জোট করলাম। নির্বাচন করলাম ক্ষমতায় আনলাম, আসলাম। আর সেই আওয়ামী লীগের ভাইয়েরা যদি জিয়াউর রহমানকে গালি দিতে গিয়ে এরশাদকে গালি দেন তাহলে আর যাই কোথায়? তাহলে তো নতুন করে ভাবতে হবে। কি করব, কোথায় যাব? সম্প্রতি আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্যকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ভালো লাগে না, লাগবে। সময় আসতাছে চিন্তা কইরেন না’।
জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের নতুন করে ভাবনার বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এবার হয়ত জাতীয় পার্টি অন্য হিসাবে কষছে। তবে সেই হিসাবের চূড়ান্ত ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। কারণ জাতীয় পার্টির অতীত ইতিহাস বলে তাদের শেষ সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় পার্টির একটা অংশ চায় আওয়ামী লীগ ছাড়তে। আরেকটা অংশ আছে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেই দর কষাকষি করে আসন বৃদ্ধি করে নেওয়ার পক্ষে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাতীয় পার্টি নিয়ে যেভাবে বিষোদগার করছে তাতে তাদের মন গলানো বেশ কঠিন।
তারা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বড় কোনো জোট বা শক্তি এখন পর্যন্ত দেশে গড়ে উঠেনি। তাই আওয়ামী লীগকে ছেড়ে বিএনপির সঙ্গে জোট করতে গেলে জাতীয় পার্টির অনেক বেশি চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। কারণ জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এরশাদকে জেল খাটিয়েছে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো এখন যেসব কথা বলছে শেষ অব্দি এই অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। নিজেদের মূল্য বাড়ানোর জন্য অনেক সময় ছোট দলগুলো বড় হুংকার দিয়ে থাকে। গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে ব্যর্থ বলা যায়। তাই তারা আসলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। যে কারণে শেষ পর্যন্ত যে জোট বা দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি থাকবে সেদিকেই ঝুঁকতে পারে দলটি।'
এনএইচবি/আরএ/