ড. রেজা কিবরিয়ার মুখোমুখি: পর্ব -১
যুব সমাজই আমাদের দেশকে মুক্তি এবং আসল স্বাধীনতা এনে দেবে
রাজনীতির মাঠে নতুন দল গণঅধিকার আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে দলের কাঠামো ও পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন দলের নীতি নির্ধারকগণ। কোন আদর্শকে ধারণ করে আগাতে চায় দলটি? আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের অবস্থান কী হবে এসব বিষয় নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার মুখোমুখি হয়েছে ঢাকাপ্রকাশ ।
সাক্ষাৎকারে রেজা কিবরিয়া খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিতে চায় নতুন এই দলটি। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়েও সোজা সাপটা জবাব দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা আমি পছন্দ করি না। তবে কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো অসুবিধা করবে এটাতে আমি বিশ্বাস করি না।’ আর জামায়াত ইসলাম প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের আদর্শের সাথে অনেক তফাৎ আছে। কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের সাথে মিল আছে...।’
ঢাকাপ্রকাশ: আপনার বাবা তো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেই ছিলেন। আপনি গণফোরামে যোগ দিলেন আবার সেটি রেখে নতুন দলের আহ্বায়ক হলেন এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানাবেন কী?
ড. রেজা কিবরিয়া: গণফোরাম ছেড়েছি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই দল প্রতিষ্ঠা করেছি একই বছরের অক্টোবরের ২৬ তারিখে। আমি মনে করি এই দলটা শুরুতেই খুব শক্তিশালী। কারণ তাদের ৫টা সহযোগী সংগঠন আছে, তারা খুবই শক্তিশালী। সংগঠনগুলো হলো ছাত্র অধিকার পরিষদ, যুব অধিকার পরিষদ, পেশাজীবী অধিকার পরিষদ, শ্রমিক অধিকার পরিষদ ও প্রবাসী অধিকার পরিষদ। প্রত্যেকটা সহযোগী সংগঠনের অনেক লোক আছে, অনেক শাখা আছে। এই শাখা এবং সাংগঠনিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। প্রথম থেকেই অনেক লোকের সাড়া পাচ্ছি, অনেক লোক যোগদান করছেন।
ঢাকাপ্রকাশ: গণফোরাম ছাড়তে হলো কেন? এবার গণঅধিকার পরিষদ করলেন, এখানেই বা কি প্রত্যাশা?
ড. রেজা কিবরিয়া: গণফোরামে যোগদান করেছিলাম শুধু একটা মানুষের দিকে তাকিয়ে সে হলো ড. কামাল হোসেন। গণ ফোরামের অন্য মানুষকে আমি সেভাবে চিনতাম না। পরে দেখলাম গণফোরামে নির্বাচনমুখী লোক খুব কম। তারা নির্বাচনের ওপর ফোকাস না। আমি মনে করি ক্ষমতায় গিয়ে দেশে একটা পরিবর্তন আনতে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং সেই জন্য আমার মনে হয়েছে গণফোরাম আমার জন্য সঠিক প্লাটফর্ম ছিল না। নতুন এই দলের সঙ্গে কাজ করছি। আমি মনে করি যুব সমাজই আমাদের দেশকে মুক্তি দেবে এবং আসল স্বাধীনতা আনবে; এই গ্রুপটাই সেটা পারবে। দ্বিতীয়ত এদের সঙ্গে কথা বলা আমার জন্য খুব সহজ, কারণ অনেক শিক্ষিত ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবি ছেলে-মেয়েরা এই দলে আছে। তাদের সাথে কাজ করাটা আমি খুব সহজ মনে করি। তাদের একটা বিষয় বোঝাতে বেশি সময় লাগে না।
ঢাকাপ্রকাশ: দলের সাংগঠনিক কাজ কত দূর এগলো?
ড. রেজা কিবরিয়া: আমাদের পাঁচটি সহযোগী সংগঠনের একেবারে তৃণমূলে শাখা আছে। তাছাড়া ৬৪ জেলায় কমপক্ষে ৩টা বা ৪টা করে সংগঠনের শাখা ইতোমধ্যে রয়েছে। দলের জন্য এখান থেকে অগ্রসর হওয়াটা খুব কঠিন না। আমাদের দলের তৃণমূলে খুব ভাল সাংগঠনিক কাজ এরই মধ্যে হয়ে গেছে। সেটার ওপর ভিত্তি করে আরও কাজ করব। আমরা যারা কেন্দ্রীয় নেতা আছি প্রত্যেক জেলায় যাব এবং সেখানে আরও শক্তিশালী করব। জানুয়ারি থেকে সাংগঠনিক সফর শুরু হয়েছে। তার আগেও কয়েকটা জেলায় সফর করেছি। বরিশাল, টাঙ্গাইলে কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইল ও কুমিল্লাতেও হয়ে গেছে। সিলেটে আমরা কিছু কাজ করেছি। এরইমধ্যে কিছু সাংগঠনিক কাজ শুরু করেছি। আমরা যেখানেই যাচ্ছি খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। কারণ এখন যে ঘৃণিত সরকার ক্ষমতায় আছে, যারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তাদের প্রতি মানুষের আস্থা একেবারে নেই। এই সময়ে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল যদি গড়ে ওঠে, আমার মনে হয় খুব ভালো সাড়া পাব সারাদেশে।
ঢাকাপ্রকাশ: তরুণদের নিয়ে আপনি কি অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছতে পারবেন?
ড. রেজা কিবরিয়া: জ্বী, নিশ্চই। না হলে তো আমি এই যাত্রায় যুক্ত হতাম না। অন্য অনেক পথ ছিল। যেগুলো হয়তো অনেক সহজও ছিল আমার জন্য। এটা বেছে নিয়েছি কারণ আমার কাছে মনে হয় শুধু দেশ পরিচালনায় একটা গুণগত মানের উন্নতি দরকার। সেই কারণে তরুণদের সঙ্গে কাজ করার জন্য আগ্রহী।
ঢাকাপ্রকাশ: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে গণঅধিকার পরিষদ কতটুক প্রস্তুত? ৩০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী আছে?
ড. রেজা কিবরিয়া: শুরুতেই আমরা ৩০০ লোক বেছে নিইনি, এটা ঠিক। কিন্তু অনেক জায়গায় অনেক লোক সামনে আসছে, যাদের জনগণের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক। যারা জনগণকে ভালোবাসে এবং জনগণের ভালোবাসা তাদের প্রতি আছে এমন লোককেই দলে নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের বছর খানেক আগে ৩০০ আসনের প্রার্থী চিহ্নিত করা খুব একটা অসুবিধা হবার কথা না।
ঢাকাপ্রকাশ: নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে গেলে তো আগে দলের নিবন্ধন লাগবে? আপনাদের দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে আছে?
ড. রেজা কিবরিয়া: নিবন্ধনের যে শর্তগুলো আছে, আমরা সেগুলো মেনে নেওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা নিয়েছি। নিবন্ধনের জন্য আমরা কাজ করছি। নিবন্ধন না পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। আমরা যেভাবে কাজ করছি, সেভাবেই করব। নিবন্ধন পেলে হয়তো কিছু মানুষের মধ্যে অন্য ধরণের চিন্তা আসবে। কিন্তু আমি মনে করি না আমাদের দলের কাজ চালিয়ে নিতে কোন অসুবিধা হবে। নিবন্ধন করতে হলে শর্ত আছে অফিস থাকতে হবে, কমিটি করতে হবে। এগুলো এখন চূড়ান্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কমিটি করতে হবে। আমার যতটুক মনে পড়ে ১২২ টা জেলা এবং উপজেলায় কমিটি করতে হবে। সেটার কাজটা চলছে।
ঢাকাপ্রকাশ: নতুন এই দল করতে গিয়ে কোনো পক্ষের চাপ দেখতে পাচ্ছেন?
ড. রেজা কিবরিয়া: সরকার থেকে তো সব সময় একটা বাঁধা আমরা দেখেছি। আমরা যেদিন ঘোষণা করলাম ২৬ অক্টোবর। সেখানে হল গোছাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সরকারের তো বাঁধা দেওয়ার কোন অধিকার নাই, কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে হল ভাড়ার ব্যাপারে আমাদের অসুবিধা করেছে। পুলিশ জানিয়েছে অসুবিধা হবে না, কিন্তু পুলিশ লিখিত অনুমতি দেয় না। লিখিত অনুমতি ছাড়া হল এর মালিকরা ভাড়া দিতে চায় না। এই চালাকি আমাদের সাথে করেছে, সরকার তো এগুলো করবেই। আমাদের এখনও ৭ জন জেলে আছে এবং তাদের মুক্তির জন্য আবেদন করেছি। অন্যায়ভাবে আটক করেছে। ছেলেরা রাস্তায় কোনো প্রতিবাদ করলে তাদের জেলে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া, যে কোন বিরোধীতায় তারা মনে করে তাদের গদি নড়বড়ে হয়ে যায়। এধরণের মানসিকতা তো আছে। আমরা ওটা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত আছি।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনাদের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা, ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি কিভাবে দেখেন?
ড. রেজা কিবরিয়া: ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো অসুবিধা করবে এটাতে আমি বিশ্বাস করি না। ধর্ম যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে সব ধর্মের মানুষ তার ধর্মে সমান, সেটা তো কোন মানুষ বিশ্বাস করে না। যারা হিন্দু তারা মনে করে তাদের ধর্মই সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে উত্তম, আর আমরা মুসলমান আমরা মনে করি আমাদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ। ধর্ম নিরপেক্ষ ঠিক না, ধর্মের ব্যাপারে মানুষের স্বাধীনতা। তবে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছে এটার ঘোর বিরোধীতা করি। দেশের প্রত্যেকটা নাগরিক যেন স্বেচ্ছায় তার ধর্মের সকল কাজ করতে পারে এবং যেন কোন ভয় না পায়, এই দেশে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়ে রাতে তাদের ঘুমাতে হবে? নিরাপত্তাহীন তাদের নিজেদেরকে যদি মনে করে এটা আমাদের সহ্য হবে না। আমাদের সরকার ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রাখব না।
ঢাকাপ্রকাশ: যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলাম নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী?
ড. রেজা কিবরিয়া: আমাদের আদর্শের সাথে অনেক তফাৎ আছে। কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের সাথে মিল আছে। তারা তো স্বচ্ছ সুষ্ঠ নির্বাচন চায়। জামায়াতের কথা আওয়ামী লীগের কিছু দালাল এবং কিছু সাংবাদিক এই প্রশ্নটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজ। শেখ হাসিনা যদি ১৯৯০ সালে জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়ে ঐক্য তৈরি করতে পারে, তাহলে আর একজন একই জিনিস করলে সেটা আওয়ামী লীগের কাছে আপত্তিকর কেন? আমরা কোন দলকে নিয়ে ঐক্য করব সেটা নির্দিষ্ট করিনি। আমরা বলেছি যারাই দেশে স্বচ্ছ নির্বাচন চায়, তাদের সাথে আমরা কাজ করব। যারা সুষ্ঠ নির্বাচন চায় তাদের সঙ্গে আমরা আছি। ভোট চোররা সেটা চায় না। তারা বিভিন্ন বাধা বিপত্তি তৈরি করবে এটা স্বাভাবিক।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনাদের রাজনৈতিক আদর্শ কী?
ড. রেজা কিবরিয়া: আমাদের আদর্শ ঘোষণা পত্রেই আছে। আমরা কোন একজন মানুষকে ওই রকমভাবে দেখি না। যে ওই মানুষের কথায় বা ওই মানুষের আদর্শে চলব, এটা ঠিক নয়। আমাদের ওপর বিভিন্ন প্রভাব আছে। মওলানা ভাসানির শক্ত প্রভাব আছে।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনাদের পেছনে কারা আছে?
ড. রেজা কিবরিয়া: বাংলাদেশের জনগণ। আমরা ওই একটা শক্তির ওপর ভরসা করছি। আমরা মনে করি এই শক্তি বাংলাদেশের সব চাইতে শক্ত। এর সঙ্গে কোন অবৈধ সরকার, স্বৈরাচারি সরকার টিকতে পারবে না।
ঢাকাপ্রকাশ: পার্টি চালাতে তো অর্থের প্রয়োজন হয়, আপনাদের যোগানদাতা কে?
ড. রেজা কিবরিয়া: জনগণের দল জনগণ চালাবে। ছোট্ট ছোট্ট অনুদান দিয়ে অনেক দল বড় হয়েছে, এরকম বহু উদাহরণ আছে। (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) প্রেসিডেন্ট ওবামার পার্টি কিন্তু ক্লাউড কন্ট্রিবিউশন দিয়ে চলেছে। বাইডেন এর পার্টিতে বিলিয়নারদের সাহায্য নেয়নি? তারা সাহায্য নিয়েছে। কিন্তু তারা নির্ভরশীল হয়েছে সাধারণ মানুষের অনুদান থেকে। ভারতের কেজরিওয়াল, উনিও তো একই রকম ফান্ডিং করেছে। সুতরাং আমি মনে করি জনগণের দল, জনগণই চালাবে ইনশাল্লাহ।