আয়ুর্বেদিকের লাইসেন্সে বানানো হচ্ছে প্যারাসিটামল
ফাইল নম্বর ১০৯। এটি ’হেলমো ফার্মাসিউটিক্যালস’-এর ওষুধ বানানোর ফাইল। আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতের লাইসেন্স রয়েছে এই প্রাতিষ্ঠানটির।
পুরান ঢাকার একটি ওয়ার্কশপ থেকে আট ধরনের ওষুধ তৈরির ছাঁচ বানিয়ে নিয়েছে ’হেলমো ফার্মাসিউটিক্যালস’। এর মধ্যে এমনকি জনপ্রিয় প্যারাসিটামল ব্র্যান্ড ‘নাপা’ তৈরির ছাঁচও রয়েছে।
জানা গেছে, কেবল এই প্রতিষ্ঠানটি নয়, এমন অন্তত দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান আয়ুর্বেদিক ও হার্বালের লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নকল ওষুধ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, নকল ওষুধ তৈরির জন্য প্রথমে একটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হয়। এরপর সংগ্রহ করতে হয় কিছু যন্ত্রাংশ। সবশেষে প্রয়োজন হয় ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ও মোড়কজাতের লেবেল। এসব পণ্য সরবরাহের আগে ক্রেতার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স রয়েছে কি-না সে বিষয়টি যাচাই করে নেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। মূলত নকল ওষুধ তৈরির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রতিটি ধাপে ওষুধ উৎপাদনের লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনীয়তা মেটাতেই নকল ওষুধ কারবারীরা সংগ্রহ করেন ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের লাইসেন্স।
ওষুধের যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য দেশের একমাত্র অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফাতেমা ইঞ্জিনিয়ারিং। এই প্রতিষ্ঠানটি এরমধ্যে ওষুধ তৈরির বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানে। যার মধ্যে বেশিরভাগ নিয়েছে আয়ুবের্দিক ও ইউনানি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করার আগে তাদের কাছ থেকে লিখিত নেওয়া হয়েছে যে ‘এসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে কোনো প্রকার নকল বা অবৈধ ওষুধ তৈরি করলে ফাতেমা ইঞ্জিনিয়ারিং দায়বদ্ধ থাকবে না।’
ফাতেমা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সত্ত্বাধিকারীদের একজন আব্দুর রহমান। তার দাবি, দেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারাই একমাত্র ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদিত। এ জন্য তারা এ ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরির আগে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন রয়েছে কি-না তা যাচাই করে নেন। পাশাপাশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একটি লিখিতও রাখেন ।
দেশের কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে তারা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে থাকেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকে। তবে দেশীয় ইউনানি ও আয়ুবের্দিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছ থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে থাকেন।
এদিকে রবিবার (১৯ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ সেবনের পরামর্শ (প্রেসক্রিপশন) দিলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, আগে অধিকাংশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ তরল ধরনের হলেও এখন ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল ধরনের হচ্ছে। এর ফলে সহজেই ইউনানি ও আয়ুর্বেদিকের লাইসেন্স ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ করে জনপ্রিয় বিভিন্ন অ্যালোপেথিক ওষুধ তৈরি করছে কিছু অসাধু কারবারী। পরে এসব নকল ওষুধ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলা থেকে উপজেলা, এমনকি গ্রামেও।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ.কে.এম হাফিজ আক্তার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ওষুধ আসল হোক বা নকল হোক এটি তৈরি করতে নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। এসব যন্ত্রাংশ পুরান ঢাকার কয়েকটি ওয়ার্কশপে তৈরি হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এসব যন্ত্রাংশ ঢাকার বাইরে স্থাপন করে নকল ওষুধ উৎপাদন করে তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না। তাদের মতে, একজন খুনি হাতে গোনা কয়েকজনকে হত্যা করে। অন্যদিকে, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারিরা নীরবে অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তাদের রুখতে হবে। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের বিকল্প নেই। একইসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাকে নিয়মিত বাজার তদারকি করতে হবে। ওষুধের পাইকারি বাজারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালাতে হবে।’
নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারী কারখানার মালিকদের গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করার জন্ জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এ ব্যাপারে জনসাধারণকেও ওষুধ কেনার সময় সচেতনতার পরিচয় দিতে বলছেন। ওষুধ প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানির কি-না এবং তার মেয়াদ রয়েছে কি-না, তা দেখে কিনতে হবে বলে তারা মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক ডা. মো শাহ এমরান বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে যান। সাধারণত যারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন, তারা নকল ওষুধ বিপণনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু এদের ধরলেই হবে না, এই চক্রের মূল হোতাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি আমাদের কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যেমন, নকল ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রেও একটি ল্যাবরেটরি, অনেক ধরনের যন্ত্রাংশ, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল প্রয়োজন হয়। এ জন্য মেডিকেল যন্ত্রাংশ কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িতসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ওপর নজরদারী রাখা প্রয়োজন।
এদিকে ওষুধ প্রশাসনের তথ্য বলছে, মানহীন ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতের জন্য চলতি বছরে ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এরমধ্যে চারটি অ্যালোপেথিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক।
আরও পড়ুন: কারাদণ্ডের বিধান রেখে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক শিক্ষা আইন অনুমোদন
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ’ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ঔষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে আর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। আগে যারা অনুমোদন নিয়ে রেখেছিলেন, তাদের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। ত্রুটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অনুমোদন স্থগিত এমনকি স্থায়ীভাবে বাতিল করা হচ্ছে।’
এনএইচ/এএন