ঈদকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন প্রতারক চক্র
পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দেশব্যাপী অনলাইনে প্রতারক চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পেজ খুলে আকর্ষণীয় পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারকরা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
পুলিশের একটি তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকদিনে এমন একাধিক চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে। চলতি মাসে রাজধানী থেকেই অন্তত ২৭ জনকে অনলাইনে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
এদিকে, রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এসব চক্রকে শনাক্ত করে কাজ করছে পিবিআই, সিআইডি ও ডিবি। সরকারি বাহিনীর এসব সংস্থা বলছে, অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা উচিত। যে প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করবে সেটি কী আসল না ভুয়া সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নিন। বিভিন্ন পণ্য অর্ডারের আগে লেনদেন নয়, মালামাল পেয়ে লেনদেন করলে হয়তো প্রতারকরা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবেন না।
প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন এক ব্যক্তি জানান, গত ৭ জানুয়ারি ‘তাবিহা শাড়ী হাউজ’ নামের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে ভারতীয় দুটি শাড়ি অর্ডার দেওয়া হয়। অগ্রিম ৫৫০ টাকা পেজের মালিককে বিকাশও দেওয়া হয়। পরের দিন একজন ডেলিভারিম্যান ফোন করে বলেন, ‘আপনার পণ্য আমার হাতে, আমি এখন নয়াপল্টনে আছি। পেজের মালিকের কাছ থেকে প্রোডাক্ট কোড দিলে আমি শাড়ি ডেলিভারি দেব।’ তখন পেজে দেওয়া নম্বরে ফোন দিলে পেজের পরিচালক জানায়, পুরো টাকা পেইড করতে হবে, অন্যথায় ডেলিভারিম্যান যাবে না। অগ্রিম দেওয়া ৫৫০ টাকা ফেরতও দেওয়া হবে না।
অনলাইনে থ্রি পিস কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ইডেন কলেজের নুপুর। তিনি বলেন, 'গর্জিয়াস মডেলের থ্রিপিস দেখিয়ে প্রতারক চক্র খুব কম টাকার থ্রি পিস পাঠিয়ে দেয়। আগে তারা বিকাশে কিছু টাকা নিয়ে নেয়। এভাবে কয়েকবার প্রতারণার শিকার হয়েছি। তাই এখন অনলাইন থেকে কেনাকাটা করি না।'
অনলাইনে একটি মোবাইল অর্ডার দেন মহাখালীর শিমুল। সেটি কুরিয়ার সার্ভিসে এসেছে জানিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস থেকে শিমুলকে ফোন করা হয়। এরপর কুরিয়ার সার্ভিসে পেমেন্ট করে মোবাইল খুলে দেখা হয় তার মধ্যে কাগজ আর মোবাইলের একটি খালি কভার। পরে তিনি বনানী থানায় একটি জিডি করেন কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এরপর প্রতারকরা শিমুলের কল রিসিভ করেন না।
অনলাইনে প্রোডাক্ট কিনে প্রতারণার শিকার হওয়া একাধিক ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা অনলাইনে কেনাকাটার কথা বলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে তারা খুব মিষ্টি ভাষা ব্যবহার করে। অনেকেই তাদের ভাষায় মুগ্ধ হয়ে যায়। তারা কথায় বিশ্বাস অর্জন করেন। অনেক ক্রেতা সরল মনে প্রতারকদের বিশ্বাস করে আগে পণ্য কেনার জন্য বিকাশে বা বিভিন্নভাবে টাকা পাঠিয়ে দেয় এবং প্রতারণার শিকার হয়। প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিরা বলছে, সামান্য কিছু সর্তকতা অবলম্বন করলেই অনলাইনে প্রতারক চক্রের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ঈদকে কেন্দ্র করে তারা সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের দাবি, অবিলম্বে অনলাইনে নামধারী ব্যবসায় ও ফেক আইডি বন্ধ করা হোক অন্যথায় সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়েই যাবে।
প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, অতিরিক্ত সচেতন না হলে প্রতারকের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব না, কারণ প্রতারক চক্রের সব কৌশল প্রায় একই ধরনের। কথার ফাঁকে তারা ক্রেতাদের আটকে দেয়।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগের শংকর এলাকা থেকে অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণার অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই প্রতারকরা অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে থাকত। অবশেষে তাদের গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. বাপ্পি হাসান, মো. আরিফুল ওরফে হারিসুল, মো. সোহাগ হোসেন, মো. বিপ্লব শেখ ও নুর মোহাম্মদ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যবহার অযোগ্য ও অতি নিম্ন মানের পুরনো ছেঁড়া শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি পিসসহ বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী জব্দ করা হয়। এ ছাড়া প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত আইফোন, ল্যাপটপ ও ২১টি অনলাইন শপিং পেজ জব্দ করা হয়।
তাদের গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, এ চক্রের তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে সারাদেশে অনলাইনে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে । এ চক্রের অন্যতম সদস্য হলো- বাপ্পি হাসান ও আরিফুল।
গোয়েন্দারা জানায়, রমজানের শুরু থেকেই প্রায় সারাদেশে অনলাইনে প্রতারক চক্র বেড়ে গেছে। ঈদকে সামনে রেখে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিভিন্নভাবে তারা প্রতারণা করছে। অনেকে সামান্য টাকা প্রতারিত হওয়ায় পুলিশকে জানাতে নারাজ। সারাদেশে এমন প্রতারণার শিকার অনেকই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, এসব প্রতারকদের ধরতে অবিলম্বে সারাদেশে মাঠে নামবে গোয়েন্দা দল। ইতিমধ্যে তারা বেশ কয়েকটি চক্র শনাক্ত করেছে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি প্রতারক চক্রের ফেসবুক পেজ ও বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসায় নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তথ্যপ্রমাণ পেলেই এদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে জানতে গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. রাজীব আল মাসুদ বলেন, ‘ঈদকে সামনে রেখে অনেকেই মার্কেটে গিয়ে ঝামেলা এড়াতে অনলাইনে কেনাকাটা করছেন। এ সুযোগে কিছু প্রতারক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আকর্ষণীয় পোশাকের কমমূল্যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্ডার করে প্রতারিত হচ্ছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম-দক্ষিণ) মো. সারোয়ার জাহান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, বেশ কয়েকটি তদন্তে এ ঘটনার মূল বিষয়টি উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অনলাইন থেকে কেনাকাটা করার সময় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তারা বিভিন্ন পণ্য কেনেন এবং প্রতারণার শিকার হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বস্ত কি না তা বুঝে কেনাকাটা করা উচিত।
তিনি বলেন, রমজানে রাস্তায় অতিরিক্ত যানজট থাকে এবং মার্কেটে ভিড় থাকায় অনেকে বিভিন্ন শপিং মলে গিয়ে কেনাকাটা করতে ইচ্ছুক না, এ কারণে তারা অনলাইনে কেনাকাটা করছে এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সবাইকে এসব বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে তাহলে এসব প্রতারণা থেকে মানুষ কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার ডিসি (মিডিয়া) ফারুক হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘অনলাইন প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ফেসবুক পেজ খুলে পণ্যের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে থাকে। এসব প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে হলে অতিরিক্ত লোভ এবং সবাইকে সচেতন হতে হবে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, সারাদেশে অনলাইন চক্রের প্রতারণা বেড়ে গেছে, এদের ধরতে সিআইডি তৎপর রয়েছে। প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ আমলে নিয়ে কয়েকটি অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তদারকি করা হচ্ছে। কেউ যেন প্রতারিত না হয় সেই বিষয়ে লক্ষ রেখে কাজ করছে সিআইডি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন খান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, রমজানের আগে থেকেই প্রতারক চক্রের সদস্যদের ধরতে আমাদের র্যাবের অভিযান চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অনলাইন প্রতারক চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অনলাইনে ফেক পেজ ও ফেক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সারাদেশে ঈদের আগে প্রতারক চক্রদের ধরতে সোচ্চার রয়েছে র্যাবের গোয়েন্দা দল। ঈদকে সামনে রেখে আমরা সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে সারাদেশে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি।
কেএম/টিটি