‘ফোনে রিং হলেই বাবা বাবা বলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সন্তানেরা’
বুলবুল খুব ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ ছিল। সবাই তাকে খুব পছন্দ করত। বুলবুল ফ্রিতেই অনেক মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিত। আমরা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খুব ভালো ছিলাম। বুলবুলকে ছাড়া আমাদের ভালো লাগে না এই রোজার দিনে আমরা ওকে খুব মিস করছি। সামনে ঈদ ছেলে মেয়েরাও খুব মিস করছে তাকে। ঘাতকেরা বুলবুলকে কেন মারল? ওরা আমার সন্তানদের এতিম করে দিল। আমার সস্তানেরা সব সময় তাদের বাবার অপেক্ষায় থাকে। আমি এখন কী বুঝ দিব ওদের। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে এভাবেই কথা বলছিলেন মিরপুরে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হওয়া দন্ত চিকিৎসক বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আক্তার।
শাম্মী আক্তার বলেন, বুলবুল স্বামী হিসেবে অনেক ভালো মানুষ ছিল। আমরা পরিবার নিয়ে খুব সুখে ছিলাম। ঘটনার দিন মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে নিজের ঠিকাদারি ব্যবসার কাজে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য ভোরে ফজরের নামাজ শেষে বাসা থেকে রওনা হয় বুলবুল। ঘটনার দিন সকালে বড় মেয়েকে নিয়ে বাসার কাছেই মনিপুর স্কুলে যাবার সময় তার বাবা মো. ইয়াকুব এর ফোন 'মারে, বুলবুল নাই।' যেন আকাশ ভেঙে মাথার উপর পড়ল। রিকশা নিয়ে প্রতিবেশী এক নারীর সহযোগিতায় দুই সন্তানকে কোলে করে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখি সেখানে পড়ে আছে আমার বুলবুলের লাশ। এ ঘটনার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না।
এ বিষয়ে শাম্মী আক্তার মিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন সেই মামলায় চিকিৎসক বুলবুলকে হত্যার অভিযোগে ৪ আসামিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পরে ডিবি পুলিশ জানায়, এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে ৫ জন ছিনতাইকারী জড়িত ছিল আমরা সিসিটিভি দেখে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি তবে এখনো একজন বাইরে রয়েছে তাকে ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।
বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আক্তার বলেন, আমার স্বামী কিছুক্ষণ পরপর ফোন করে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। ভিডিও কলে বাবাকে দেখত ছোট্ট সামী। আর তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। এখন ফোনে রিং হলেই বাবা বাবা বলে ডেকে ফোনের কাছে যায়। কানে ফোন ধরে, কিন্তু সামীর কানে আর বাবার কথা বাজে না। একটু পরে ফোন ফেলে দিয়ে কান্না করে। দেড় বছর বয়সী সামীকে কী বুঝ দিব আমরা? সেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
এদিকে বড় সন্তান আমাদের আদরের মেয়ে আয়ন মন মরা হয়ে বসে থাকে সারাদিন। কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলে না, খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করতে চায় না। মেয়ে চোখে পানি নিয়ে বাবার ছবি একে দিন পার করছে । কিছু কিছু সময় বাবার ছবি এঁকে কাঁদছে সে। বারবার বলে আম্মু এটা বাবা না? ছয় বছরের মেয়ের কাছে ড্রইংয়ের এই ছবিতেই যেন বেঁচে আছে আমাদের বুলবুল। বুলবুলের কথা শুনলে আমার মনটা ভরে যেত, ওকে আমরা পরিবারের সবাই প্রচুর মিস করছি। রোজা-ঈদকে সামনে রেখে আমাদের বারবার মনে পড়ছে তার কথা। সে ছাড়া আমরা এই প্রথম রোজা কাটাচ্ছি, ঈদ ও কাটাতে হবে ছেলে মেয়েরা ভাবছে হয়তো ঈদে তাদের বাবা আসবে। আমার সন্তোনেরা ওদের বাবার অপেক্ষায় রয়েছে। আমাদের সময় কাটছে বর্তমানে মেয়ের আঁকা ছবি দেখে।
বুলবুলের পরিবার জানান, চিকিৎসক বুলবুল আহমেদ সব ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানদের ভুলতেন না। চেম্বার থেকে একটু পরপর স্ত্রী শাম্মীকে ফোন করে খোঁজ নিতেন বাচ্চাদের। কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। আজ তিনি তাদের কাছ থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছেন।
ডাক্তার বুলবুলের মেয়ে আয়নের আকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাবা-মা আর তারা দুই ভাই-বোন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাত ধরে আছে আয়ন। আর ছবির উপরে লেখা- ‘প্রিয় বাবা, তুমি কোথায়?’ ‘আব্বু, তোমাকে ভালোবাসি, আব্বু তোমাকে মিস করি!’
শাম্মী বলেন, ‘বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানো ও ভালো মানুষ করে গড়ে তুলতে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম। কিন্তু আজ খালি হাতে গ্রামে চলে আসতে হলো।’
মগবাজারের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দন্ত চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা শেষে মগবাজার এলাকাতেই রংপুর ডেন্টাল নামে একটি চেম্বার খুলে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন ডা. বুলবুল। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন বলে ‘গরীবের ডাক্তার’হিসেবে তার পরিচিতি তৈরি হয়।
রংপুর শহরের কোতয়ালি ভগিবালাপাড়া গ্রামের আব্দুস সামাদ ও বুলবুলি সামাদ দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বুলবুল। ২০০৮ সালে দিনাজপুরের মেয়ে শাম্মীকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের কোল জুড়ে আসে মেয়ে আয়ন ও ছেলে সামী। পরিবার নিয়ে পশ্চিম শেওড়াপাড়া আনন্দবাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন ডা. বুলবুল।
ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হওয়ার ১৭ দিন পার হয়েছে ইতোমধ্যে। কান্না আর হাহাকার থামছে না পরিবারে। প্রতি বছর রমজানে পরিবারের সবার খোঁজ-খবর নেওয়া, গ্রামের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো তার রুটিন কাজ ছিল। কিন্তু এবারের রমজানে আর দেখা মিলছে না গরিবের ডাক্তারের।
ডাক্তার বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী বলেন, ‘আমাদের মেয়ে আয়ন বাসায় সব সময় ওর বাবার কাছেই থাকত, খাওয়া-দাওয়া গোসল করাত ওর বাবা। প্রতিদিন রাতে বাবার অপেক্ষায় বসে থাকত ছেলে-মেয়ে দুজনই। বুলবুল রাতে বাসায় এলে তার হাতেই খাবার খেত ওরা। পরে তার বুকের ওপর ঘুমাত আয়ন আর সামী।’
বুলবুলের খুন হওয়াটাকে কোনোভাবেই ছিনতাইকারীর কাজ মানতে নারাজ শাম্মী, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এটা কখনোই ছিনতাই হতে পারে না। আমার ইচ্ছা ছিল ছিনতাইকারীদের সঙ্গে কথা বলার, তারা কেন বুলবুলকে মেরে ফেলল জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলাম। টাকা, মোবাইল ফোন চাইলেই তো দিয়ে দিত। এ ছাড়া যে ছুরি মারছে বুলবুলকে, সেই আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। শাম্মী বলেন, কার কাছে বিচার চাইব, কে আমার সন্তানদের কাছে তাদের বাবাকে ফিরিয়ে দেবে?
ডা. বুলবুল গত ২৮ মার্চ ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোয়াখালী যাওয়ার জন্য শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা করে যাচ্ছিলেন মিরপুর বাসস্ট্যান্ডে। কিন্তু কাজীপাড়া মেট্রোরেলের সাত নম্বর স্টেশনের নিচে ২৭৮ নম্বর পিলারের কাছে পৌঁছালে তার গতিরোধ করে তিনজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি। তাকে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যায় তারা। পরে ২৯ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারীদের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড চলাকালে তারা দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে চাইলে তাদের হাজির করা হয়। বিচারক তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
কেএম/এমএমএ/