ঠেকানো যাচ্ছে না টাকার মান
রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় কোনো ক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না ডলারের বিপরীতে টাকার মান। বর্তমানে এক ডলার নিতে ব্যাংকে দিতে হচ্ছে ৮৬ টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ এক ডলারের কোনো পণ্য আমদানি করতে ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে এ টাকা দিতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত কমছে টাকার মান। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিপরীতে গত ২২ মার্চ প্রতি ডলারের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় নির্ধারণ করেছে। এর আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে বিভিন্ন শিল্পের মেশিনারিজ, কাঁচামাল ও বিলাসী পণ্যের আমদানিও বেড়ে গেছে।
অপরদিকে রেমিট্যান্স কম এসেছে। তাই ডলারের দাম সব রেকর্ড ছাড়িয়ে টাকার মানও কমে গেছে। এতে ব্যবসায়ীদের আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়নমূলক কাজের অগ্রগতিতেও ভাটা পড়েছে। ঢাকা-আশুলিয়ার মতো বড় বড় প্রকল্পও সংশোধন করতে হচ্ছে। তবে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হচ্ছেন।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। গত জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তিনি ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন। সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ায় তারা ব্যাংকিং চ্যানেলেই বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাতে থাকেন। এর ফলে গত অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ে। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে ডলার বিক্রি করছে। এমনকি টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে বাধ্য হয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় ও চিকিৎসা খাত ছাড়া সব পণ্য আমদানির ঋণপত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। অপরদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। তাই খুব সহসাই কেটে যাবে ডলারের সংকট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩ হাজার ২০৭ কোটি (৩২দশমিক ০৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে খরচ হয়েছে ৫ হাজার ৪৩৭ কোটি ৭০ লাখ (৫৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন) ডলার। আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ২৩০ কোটি ৭০ লাখ (২২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার বা এক লাখ ৯২ হাজার ৩৯৭ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি ডলার ৮৬ দশমিক ২৫ টাকা হিসাবে।
অপরদিকে জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে মার্চ মাস থেকে বাড়তে শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এপ্রিল মাসের ১৩ দিনেই ৯২ কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বাণিজ্য ঘাটতির বিশাল হিসাবের প্রভাব পড়ছে ডলারের চাহিদা ও দামে। ফলে ডলারের বাড়তি চাহিদা মেটাতে এবং দর যাতে না বাড়ে সে লক্ষ্যে নিয়মিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় দিন ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমেই এলসি ওপেন করছেন আমদানিকারকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘মূলত প্রবাসীদের আয় ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশে ডলার আসে। অপরদিকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সম্প্রতি বিভিন্ন কাঁচামাল ও মেনিশারিজের বড় বড় এলসি খোলার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এসব কারণে ডলারের চাপ বেড়েছে। তবে আশার কথা ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্সের গতি বাড়তে শুরু করেছে। গত মাসে অনেক বেশি এসেছে। সর্বশেষ গত মার্চে ১৮৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এপ্রিলে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে গত কয়েকটি ঈদ ভালোভাবে করতে পারেনি দেশের মানুষ। এবার করোনামুক্ত পরিবেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ভিন্ন আমেজে ঈদ উদযাপিত হবে। প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি করে অর্থ পাঠাচ্ছেন।‘
তিনি আরও বলেন, ‘ প্রত্যেকটা ব্যাংক সচেতন। তারাও ২৪ ঘণ্টা ডলার রাখার চেষ্টা করছে। ডলারের মান নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রতি মাসে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসের এই কয়দিনে ৩২ কোটি ১০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিলাসী পণ্যের আমদানি রোধে বাধ্য হয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় ও চিকিৎসা খাত ছাড়া সব পণ্য আমদানির ঋণপত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য গত ১১ এপ্রিল ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
আগে সব ধরনের আমদানি ঋণপত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মার্জিনের হার নির্ধারণ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু নতুন নির্দেশনায় শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরফলে ধনীরা যেসব বিলাসী পণ্য আমদানি করে তা অনেকটা কমে যাবে। এরফলে ডলারের ঊর্ধ্বগতি কমে যাবে।’
টাকার মান কমলেও সন্তোষজনক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ
অস্বাভাবিক আমদানি বৃদ্ধির পরও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। এটা দিয়ে বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। গত নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) রপ্তানি আয় ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার হওয়ায় এ মজুদ বেড়েছে।
জেডএ/এসএন