মেট্রোরেল-১ নির্মাণ কাজ শুরু জুলাইয়ে
রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে সরকারের নানান পদক্ষেপের অন্যতম একটি হচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্প। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমেটেডের অধীনে রাজধানী জুড়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শেষ করতে মেট্রোরেলের চারটি রুটকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে। তারপরও মেট্রোরেলের নতুন রুটগুলোর নির্মাণ কাজে দেখা দিয়েছে ধীর গতি।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পভুক্ত মেট্রোরেল লাইন-১ এর কাজ আটকে আছে চার কারণে। ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মনিটরিং টাস্ক ফোর্স এর ১৬তম সভায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
অবশ্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, সংকটগুলো আপাতত দূর হয়ে গেছে। আগামী জুলাই মাসে মেট্রোরেল লাইন-১ এর কাজ শুরু হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে এই লাইনটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য চালু করে দেওয়া হবে-এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
ডিএমটিসিএল এর আওতায় বাস্তবায়নাধীন চারটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি ও ফাস্ট ট্যাক প্রকল্পের মনিটরিং কমিটির ১৪ ও ১৫তম সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে গত মাসে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকের কার্যপত্রে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ি জানা গেছে, কর্পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি খুবই ধীর। এ জন্য দুটি প্রধান কারণকে দায়ি করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে-বাংলাদেশ রেলওয়ে হতে কমলাপুর আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন বক্স, প্রবেশ ও বহির্গমন পথ এবং ভেন্টিলেশন শ্যাফট এর অবস্থান চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হওয়া। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক কমলাপুর স্টেশনের ইউটিলিটি ভেরিফিকেশন সার্ভে কাজের অনুমোদন না পাওয়া।
মনিটরিং কমিটির সভায় মেট্রোরেল লাইন-১ এর কাজের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এখন মেট্রোরেল-১ বাস্তবায়নে চারটি চ্যালেঞ্জ এর মুখে রয়েছে ডিএমটিসিএল।
এই চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে-চারটি লানসিং শ্যাফট ও ১২তম আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন এলাকায় ওপেন কাট পদ্ধতিতে নির্মাণকালীন ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট; প্রবেশ/বহির্গমন পথ ও ভেন্টিলেশন শ্যাফট এর অবস্থান; অস্থায়ী কনস্ট্রাকশন এর অবস্থান নির্ধারণ এবং পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের সদ্য নির্মিত ভেহিকল আন্ডারপাস এর অবকাঠামো (পিয়ার) নির্মাণ।
অবশ্য ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ, এ এন ছিদ্দিক শনিবার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আপাতত লাইন-১ এর নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে আর তেমন সমস্যা নেই।’
তিনি বলেন, ‘কমলাপুরের কাজ শিগগির শুরু করা যাবে। এখানে আন্ডারগ্রাউন্ডে (পাতাল) থাকবে মেট্রোরেল-১ এবং উপরে থাকবে মেট্রোরেল-৬ এর স্টেশন।’
ডিএমটিসিএল এর এমডি জানান, এখন শুধু দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ‘রাইট অব ওয়েভ’ হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছি। সিটি করপোরেশনের কাছে তারা একটা প্রস্তাব দিয়েছে। ‘সেখানে ‘রাইট অব ওয়েভ’ হস্তান্তরের জন্য লিখেছি। দুই সপ্তাহ আগে লেখা ওই চিঠিতে আমরা বলেছি, নির্মাণকালীন হস্তান্তর করতে। তারা হস্তান্তর করলে আমরা কাজ শুরু করব।’
এম এম এন ছিদ্দিক আর জানান, যেকানো রি-লোকেশন প্রয়োজন সেখানে রি-লোকেশন করা হবে। আর যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে আমরা কাজ শুরু করে দেব।
ডিএমটিসিএল তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোলাইন-১ দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এই অংশের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। এই অংশে মোট ১২টি স্টেশন হবে, যার সবগুলোই হবে আন্ডারগ্রাউন্ড (পাতাল)। এটিই হবে দেশের প্রথম পাতাল রেল।
বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর অংশে যে ১২টি স্টেশন নির্মাণ হবে সেগুলো হচ্ছে- বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, নর্দ্দা, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরিঝিল ইস্ট, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর। এই স্টেশনের সবগুলোই নির্মাণ হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে (পাতাল)।
অপর অংশটি হবে পূর্বাচল রুটে। নতুন বাজার থেকে থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত। এই অংশের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১১ দশমিক ৩৬৯ শতাংশ। এই অংশটি পুরোপুরি উড়াল পথে হবে। এই অংশে নয়টি স্টেশনের দুটি হবে পাতাল বা আন্ডারগ্রাউন্ডে। বাকি সাতটি হচ্ছে উড়াল।
নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল টার্মিনাল পর্যন্ত স্টেশন হচ্ছে নয়টি। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড। এ দুটি হচ্ছে-নতুনবাজার ও নর্দ্দা। বাকি সাতটি স্টেশন হচ্ছে উড়ালপথে। এগুলো হচ্ছে-জোয়ারসাহারা, বোয়ালিয়া, মাস্তুল, শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্ট্রাল, পূর্বাচল ইস্ট ও পূর্বাচল টার্মিনাল।
নতুন বাজারে থাকবে ইন্টারচেঞ্জ। যেটি ব্যবহার করে যাত্রীরা বিমানবন্দর, পূর্বাচল এবং কমলাপুরের দিকে যাতায়াত করতে পারবেন।
মেট্রোরেল-১ এর নির্মাণ কাজে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপানি সাহায্য সংস্থার (জাইকা) ঋণের পরিমান হচ্ছে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত।
বর্তমানে মেট্রোরেল-১ এর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির কাজ চলছে। ইতিমধ্যে নকশা তৈরির কাজ ৯২ শতাংশ শেষ হয়েছে।
ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের ডিপো নির্মাণের জন্য নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জ ও ব্রাহ্মণখালি মৌজায় ৯২দশমিক ৯৭২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের কাজ প্রক্রিয়াধীন।
ইতিমধ্যে সাতটি প্যাকেজে দরপত্র আহবান করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রকল্পের নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শমক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের লক্ষ্যে আএফপি মূল্যায়ন প্রতিবেদন সম্মতির জন্য গত ২৬ জানুয়ারি জাইকাতে পাঠানো হয়েছে। ডিপোর ভূমি উন্নয়নের জন্য প্যাকেজ সিপি-১ এর কারিগরি দরপত্র মূল্যাযন প্রতিবেদনের উপর জাইকার সম্মতির পাওয়া গেছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে।
প্যাকেজ সিপি-৫, সিপি-৬, সিপি-৪ এর প্রাক-যোগ্যতার আবেদন আহ্বান করা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্যাকজ সিপি-১২ এবং গত মার্চ মাসে প্যাকেজ সিপি-৯, ১০ ও ১১ এর প্রাক যোগ্যতা দলিল এবং ফেব্রুয়ারি মাসে প্যাকজ-সিপি-৩ এর সংশোধিত প্রাকযোগ্যতার দলিল জাইকার সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে।
মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আগামী জুলাই মাসে এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে ডিপো নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অধিগ্রহণকৃত ভূমি বুঝে পেয়েছি। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায়।
তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালের ডিসেম্বরে এই রুট মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।’
এনএইচবি/এমএমএ/