সড়ক দুর্ঘটনায় সাবিনার মৃত্যু
মা ছাড়া ভালো নেই শিশু ওহী ও রাহী
রাজধানীসহ দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। এতে অনেক মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করছেন, কেউ কেউ আবার গুরুতর আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হচ্ছেন। কিছুতেই থামছে না এ দুর্ঘটনা। একটি দুর্ঘটনা একটা পরিবারের সারা জীবনের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি দুই মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে ডেন্টাল কলেজের সামনে বাসের ধাক্কায় সাবিনা ইয়াসমিন (৩১) নামের এক নারী মারা যান। এ দুর্ঘটনায় তার দুই মেয়ে হুমায়রা ইয়াসমিন ওহী (১০) ও রাফিয়া ইয়াসমিন রাহী (৮) আহত হয়। ওহী ও রাহী বিএন স্কুলের শিক্ষার্থী।
জানা যায়, সাবিনা ইয়াসমিনের গ্রামের বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলায়। তার স্বামীর নাম মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে রফিকুল ইসলাম। রফিকুল নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। দুই মেয়েকে নিয়ে তারা মিরপুরের বিআরবি কলোনির বি-৩৭ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলায় বসবাস করতেন।
এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পুলিশ জানায়, এটা একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। প্রথমে নিহত সাবিনাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তার অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশি তথ্য বলছে, সাবিনার মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। নিহতের মরদেহের দাফন সম্পন্ন হয়েছে কোনো প্রকার ময়নাতদন্ত ছাড়াই।
সাবিনার ভাই মামুনুর রশীদ বলেন, বগুড়ার ধুনটে এলাকায় আমার বোনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আমরা লাশ পোস্টমর্টেম করতে দেইনি।
স্ত্রী সাবিনা মারা যাওয়ার পর তাদের দুই মেয়ে ওহী ও রাহী কেমন আছে জানতে চাইলে নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়েরা মা ছাড়া ভালো নেই। বড় মেয়ে ওহী সব সময় চিন্তামগ্ন থাকছে। পড়ালেখার প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে অধিকাংশ সময় অনুশোচনায় ভুগছে বলে আমার মনে হচ্ছে। আর ছোট মেয়ে রাহী প্রায়ই মা মা বলে কান্নাকাটি করে। তাদের মা যে, আর পৃথীবিতে নেই, সে কোনো দিন আসবে না, এটাই আমি ওদের বুঝাতে পারছি না।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমার দুইটা মেয়েই আহত হয়। মাঝে মাঝে ওরা দুজনে বলাবলি করে চোখের সামনে আমাদের মা মারা গেল! ও মা তুমি কোথায়! ফিরে এসো! এসব নানান ধরনের কথাবার্তা শুনে আমার ও খুব খারাপ লাগে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি সব সময় আমার মেয়েদের সার্বিক বিষয়ে খেয়াল রাখছি। ওদের আমিও অনেক ভালোবাসি। তবে ওরা রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে তাদের মাকে খুব মিস করছে আমি সেটা বুঝতে পারছি।
তিনি বলেন, একটি সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনকে তছনছ করে দিল। এমন ঘটনা যাতে আর কারো জীবনে না ঘটে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, মাকে হারিয়ে দিশাহারা আমার সন্তানেরা। বড় সন্তানকে সব সময় সান্ত্বনা দিচ্ছি। ওকে দেখার মতো নেই, শুকিয়ে গেছে, ও কিছুতেই এ দুর্ঘটনা মেনে নিতে পারছে না। কারো মুখে ওর মায়ের কথা শুনলে ওরা কাঁদতে শুরু করে। এজন্য আমি ওদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখি।
এদিকে এ ঘটনার দিন সাবিনার মরদেহ যে স্ট্রেচারে ছিল, সে স্ট্রেচার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ওহীকে। সে অবিশ্বাস নিয়ে বারবার মাকে ছুঁয়ে দেখছিল আর মা মা বলে ডাকছিল। এসময় সাবিনার ছোট মেয়ে রাহী উপস্থিত লোকজনকে ডেকে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আম্মুকে একটা বড় ডাক্তার দেখাও। প্লিজ তোমরা আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আমার আম্মুর কী হয়েছে ও আম্মু কথা বলো...! আব্বু আম্মু কথা বলছে না কেন?'
দেখা যায়, ঘটনার দিন হাসপাতালে নিহতের স্বামী রফিকুলকে জড়িয়ে ধরে বাবা ও মেয়েরা কাঁদতে থাকেন এবং ছোট মেয়েটি আত্মীয়স্বজনদের বারবার বলতে থাকে, আমার আম্মুর কী হয়েছে, সত্যি করে বলো তোমরা। আম্মু কথা বলছে না কেন?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত সাবিনা ইয়াসমিনের ভাই মামুন বলেন, ঘটনার দিন দুই মেয়েকে নিয়ে অটোরিকশায় স্কুলে যাচ্ছিলেন আমার বোন। পথে একটি যাত্রীবাহী বাস অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে সে ছিটকে সড়কে পড়ে যান। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমাদের বোন এভাবে চলে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে আমার ভাগ্নিরা কেমন জানি নিরব হয়ে গেছে। তারা আর আগের মতো নেই। সব সময় তাদের মাকে মিস করছে। আমরা ওদের খোঁজখবর রাখছি। তিনি বলেন, ওহী ও রাহী সব সময় অসহায়ের মতো চলাফেরা করছে। মাকে ছাড়া ওদের রোজার দিনের ইফতারেরও কোনো আনন্দ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, ওইদিন যখন নিহত সাবিনার মরদেহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয় তখন তার বড় মেয়ে খুব কান্নাকাটি করছিল। আসলেই এটা একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
এ ঘটনার সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষানটেক থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক অনয় চন্দ্র পাল বলেন, এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। এ ঘটনার তদন্ত চলমান রয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে এই ঘটনায় মামলা করা হবে কি না জানতে চাইলে ভাষানটেক থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল হাসনাত খন্দকার বলেন, মামলা এখনও করা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে তারা মামলা করার বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে কি না সে বিষয়ে আপাতত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
রিকশাকে ধাক্কা দেওয়া বাসটি এবং বাসের চালককে শনাক্ত করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, বাস বা চালক এখনও শনাক্ত হয়নি। তবে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এটি একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। এ ঘটনার পর আমাদের পুলিশ সদস্যরা গাড়িটির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়। আমরা আন্তরিকভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। মামলা হলে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
ওসি দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্টের একটি বাসের ধাক্কায় সাবিনার মৃত্যু হয়েছে।
জানতে চাইলে ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো বাস এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানা নেই।
প্রসঙ্গত, গেল মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) দুপুরে অটোরিকশায় করে দুই সন্তানকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন মা সাবিনা ইয়াসমিন। কিন্তু পথেই পেছন থেকে একটি বাস অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয় এরপর এ ঘটনায় মা ও মেয়েরা (দুজন) রাস্তায় ছিটকে পড়েন। সৌভাগ্যক্রমে দুই সন্তান বেঁচে গেলেও তাদের মা চিরতরে হারিয়ে যায়। এরপর থেকে মাকে ছাড়া ভালো নেই শিশু ওহী ও রাহী।
কেএম/টিটি