ফুটবল খেলেও যুদ্ধ হয়
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ময়দানে যুদ্ধ করেছেন অস্ত্র হাতে। সশস্ত্র সেই যুদ্ধে প্রাণ গেছে লাখ লাখ অকুতোভয় বাঙালি তরুণ, যুবকের। তার ঠিক বিপরীতে অন্যরকম এক যুদ্ধ করেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা। তারা ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য। অংশ নিয়েছেন অসংখ্য প্রীতি ম্যাচে। ব্যতক্রমী সেই যুদ্ধে তাদেরকে নানান জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। পড়েছিলেন বিহারীদের বাধার মুখেও।
একাত্তরে যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটি গঠন করা হয়েছিল সেই দলের অনেকেই আগরতলায় গিয়েছিলেন যুদ্ধের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে, প্রশিক্ষণ শেষে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে। কিন্তু তাদের কেউই শেষ পর্যন্ত ময়দানের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। অনেকে ক্ষোভ জানিয়ে বলেছিলেন, তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে এসেছেন। ফুটবল খেলতে নয়।
কিন্তু বিচক্ষণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদ এর নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের নির্দেশে তারা শেষ পর্যন্ত ফুটবল দলের সঙ্গেই যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বা জয় বাংলা ফুটবল দলে যোগ না দিলে তারা কোন রকম যুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন না। উল্টো তাদেরকে জেলেও যেতে হতে পারে। তাই বাধ্য হয়েই তারা আগরতলা থেকে কলকাতায় গিয়ে যোগ দেন ফুটবল দলে। তারপর সবই ইতিহাস। ফুটবল দিয়েও যে যুদ্ধ হয় সেটা তারা তখন বুঝতে পারেন, যখন ভারতের এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে গিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে।
যুদ্ধ করতে যেই ফুটবল দলটি গড়ে তোলা হয়েছিল:
(১)
তানভীর মাজহার তান্না। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার। তিনি বলছিলেন, ‘যুদ্ধটা তো এমনিভাবে হয়নি। যুদ্ধটাতো কারো ডাকে হয়েছে। আমরা একটা মুভমেন্টে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু জেল খাটছেন। আগারতলা মামলা, আরও অনেক মামলা…
আমরা যে মুভমেন্টে গেছি… এটাতে কিন্তু আমরা সবাই ইনভলব। খেলোয়াড়রা যে সবাই গেছি…বাংলাদেশের প্রথম যে ফুটবল টিম হয়েছে, জয় বাংলা বা স্বাধীনবাংলা ফুটবল দল এখানে কিন্তু পাঁচ থেকে সাত জন খেলোয়ার ছিলেন যারা পাকিস্তান দলের খেলোয়াড় ছিলেন। আমার কথা হল এদের যে ডাক দিল, তাজউদ্দীন সাহেবের আন্ডারে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি বানিয়ে…শামসুল হক সাহেব, ….অনেকেই ইনভলব।
বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির থ্রু দিয়ে, বাংলাদেশ বেতারের থ্রু দিয়ে দেন সবাই ইনভাইটেড। যে আপনারা সবাই চলে আসেন, পালিয়ে আসেন। দুইটা কারণ, একটা কারণ ছিল অনেকজন খেলোয়াড়কে মেরে ফেলেছিল। দ্বিতীয় কারণ বাংলাদেশ আর্মি ওয়ান্টেড লিভ টু স্টার্টভ ঢাকাতে যেন এভরিথিং ইজ নরমাল।
তাজউদ্দীন সাহেবরা সিদ্ধান্ত নিলেন… কি যে ঢাকা শহর ইজ নরমাল…
তারা কি করলেন একটা ক্রীড়া সমিতি বানালেন। বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি, বাংলাদেশ বেতারের থ্রু দিয়ে… অনেকজন খেলোয়াড় পালিয়ে গেছেন। ধরেন আমি অনেক আগে পালিয়ে গিয়েছি। ছিলাম বালুরঘাট। কর্নেল শাফায়েত জামিল সাহেব…
তানভীর মাজহার বলেন, আমাকে পিন্টু ভাই এসে নিয়ে গেল বালুরঘাট। আমি যখন কলকাতা গিয়েছি তখন দেখি ৩০-৪০ জন খেলোয়াড় চলে এসেছে।
সম্প্রতি সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জার্সি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ তানভীর মাজহার তান্না। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় শেখ আশরাফ আলী, সুভাষ চন্দ্র সাহা ও এনায়েত।
জার্সির গল্পটা বলতে গিয়ে তানভীর মাজহার বলেন, জার্সিটা ৫০ বছর পর পেলাম…এটা সুভাষের জার্সি। আমরা যে জার্সি বানিয়েছি একটা ছিল লাল রং ও একটা ছিল সবুজ রং এর। একটা স্মৃতি..। পার্ট অব মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার বলেন, ওই সময় আমরা আমরা ১৭টা বা ১৮টা ম্যাচ খেলেছি। আমরা প্রথম ম্যাচ খেলেছি কৃষ্ণনগরে। সেখানে বিরাট ভীড়। শুধু মাঠ না, মাঠটা ছোট ছিল…মাঠের পাশের বাসাবাড়িতে মানুষ আর মানুষ। সবাই বলছে জয় বাংলা জয় বাংলা…। আমি আর সেক্রেটারি লুৎফুর রহমান সাহেবসহ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, চান্স পেয়ে গেছি একটা যে আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত বাজানো না হলে আমরা খেলব না। আমার সবাই ত্যাড়া হয়ে গেলাম। তখন তো ওরা টেনশনে পড়ে গেল। কি করবে…৪০ মিনিট…সমঝোতা হল। কৃষ্ণনগরে যিনি ডিসি উনি বললেন, না ঠিক আছে, করেন। ওই ফটো টাও আছে।
আমরা জাতীয় পতাকা নিয়ে দৌড়ালাম, জাতীয় সঙ্গীত হল। ফাস্ট টাইম ইন দি হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ, ২৬শে জুলাই। ইন এ ফরেন কান্ট্রি উইদাউট অ্যানি রিকগনাইজেশন। ওরা খেলছিল ওদের অরিজিনাল ডিস্ট্রিকের নাম দিয়ে ‘কৃষ্ণনগর একাদশ’ নামে। এই খেলার জন্য পাকিস্তান ফিফার কাছে অভিযোগ করে। ফিফা বহিস্কার করে কৃষ্ণনগরকে। শুধু তাই নয়, ডিসির চাকরিও চলে গেল।
পরবর্তিতে আমরা যত ম্যাচ খেলেছি সবগুলো কিন্তু ভিন্ন নামে খেলেছি। যেমন মোহনবাগানের সঙ্গে খেলেছি। তারা নাম দিল গোস্টফর একাদশ। গোস্টফর ইজ দ্যা ফাস্ট ক্যাপ্টেন অব ইন্ডিয়া। মহারাষ্ট্রে শেষ ম্যাচ খেলেছি। সেটা ছিল মহারাষ্ট্র একাদশ- যোগ করেন তানভীর মাজহার।
তিনি বলেন, তখনকার দিনে একটাই টেলিভিশন ছিল। ইন্ডিয়ার ৭০ শতাংশ মানুষ যারা ছিল তারা কেউই হ্যাপি না।
যেমনি আমরা বিহারের শ্রীমানে খেলতে গেলাম, খেলার পর আমাদেরকে তো ধরে বসল বিহারিরা, ‘আপ লোক কেয়া কররা হ্যায়। বললাম, কেয়া কররা মানে কি হল? বলল, আপ লোক সব হিন্দুরা আয়া হে, মুলমান কান্ট্রি ভাগ হয়া…’ বললাম, ‘আপ লোক দেখিয়ে কিতায়ে…মুসলমান ক্যাতনায়ে, হিন্দু কাহা হে। এই প্রতাত শংকর হাজরা, সুভাষ আর দুত্যিন হ্যায়। আর সব মুসলমান হ্যায়।’
তারপর বললাম, ‘তোমরা উর্দু ভাষা, বিহারী ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছ। এগুলো তো আমরা বুঝি না। আমরা সব বাংলাদেশী, আমরা বাঙালী। হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম?’
তখন বলে আমরা তো মনে করছি আপনারা সব হিন্দু। এরকম বহু সমস্যা আমরা মোকাবেলা করেছি, বলেন তানভীর।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরও যোগ করেন, তখন তো আমরা গরিব দেশ। গরিব ছিলাম। আমরা থার্ড ক্লাসে ট্রাভেল করেছি। ফ্লোরে শুয়ে গেছি। ইভেন ধরেন কলকাতা থেকে বোম্বে ৩৬ ঘণ্টার জার্নি। তখন তো ইলেকট্রিক ট্রেন ছিল না। আমরা গাদাগাদি করে এত দীর্ঘ জার্নি করেছি।
যারা গিয়েছি আমরা প্রথমে যখন অনুশীলন শুরু করলাম, ম্যানেজারকে বললাম চল যাই আমরা পার্কসের কাছে অনুশীলন করি। দুদিন অনুশীলন করেছি। তৃতীয় দিনে বলে যে, আপনারা এখানে অনুশীলন করতে পারবেন না। ওরা বুঝে গেছে আমরা বাঙালি। ওখানে তো মুসলমান এলাকা। আমরা ঠিক করলাম আমরা ময়দানে চলে গেলাম। লটস অব প্রবলেম…।
আমাদের অনেক খেলোয়াড় পালিয়ে গেছে। মধ্যে এসে পাকিস্তান আর্মি আমাদের অনেক খেলোয়াড়কে হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে শাহজান ভাই, লাভলু ভাই…দে আর টেইকেন অ্যারেস্ট। সো, সরকার ভালো প্রটেকশন দিয়েছে আমাদের খেলোয়াড়দেরকে।
(২)
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আরেক খেলোয়াড় শেখ আশরাফ আলী তার সোনালী দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের খেলার মূল উদ্দেশ্য একটা জনমত সৃষ্টি করা। আমরা যেখানেই গেছি সেখানে পতাকা উত্তোলন ছাড়া খেলিনি। জনমত সৃষ্টির জন্য আমরা ভারতের যেসব জায়গায় গিয়েছি, সমস্ত জায়গায় আমরা পতাকা উত্তোলন করেছি। তখন কিন্তু আমাদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি। এটাই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। টাকা কত পাইছি, কত পাই নাই, আমার কাছে এটা কোন ফ্যাক্টর না। আসুক না ২০ লাখ ২৫ লাখ…। আমাদের মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে স্বাধীনতা।
(৩)
নরসিংদীর সন্তান সুভাষ সাহা বলছিলেন, নারায়ণগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। ওই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলাম আমি। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আমি নরসিংদীতে ছিলাম। নরসিংদীর উপর দিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা তাদেরকে প্রথমে রিসিভ করি। তারপর রুটি ও গুড় দিয়ে আপ্যায়ন করি। আমরা এক রাত নরসিংদীতে রাখি। পরদিন তারা নৌকায়, রিকশায়, কেউবা পায়ে হেঁটে যার যার গন্তব্যে চলে যান। ১১ তারিখে আগরতলা পৌঁছি।
তিনি বলেন, আগরতলা থেকে আমাদের সাতজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকতায় জাতীয় দলে, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে। এই দলে ছিলাম আমি, এনায়েত, নওশের, বিমল, নিহার আর কায়কোবাদ ভাই।
সেদিনের স্মৃতিগুলো এখনও ঝকঝকে। বলেন, আমাদের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল মোহনবাগানের সঙ্গে। যেহেতু আমরা স্বাধীন না সে কারণে গোস্টপাল একাদশ নামে তারা আমাদের সঙ্গে খেলেছিল। প্রথম খেলায় আমরা কৃষ্ণনগরে তাদের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে নিলাম। কারণ একটা স্বাধীন দেশ না হলে সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয় না, পতাকা উড়ানো হয় না। কিন্তু আমরা সেটা করতে পেরেছিলাম। এই স্বাধীন বাংলার জন্য। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রচার করা, সারা বিশ্বকে জানানো যে আমরা বাঙালিরা কি অবস্থায় আছি? আমাদের দেশের মানুষের উপর কি অত্যাচার করতেছে? কি টর্চার করতেছে পাকিস্তানীরা। এটা প্রচার করাটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্যে।
সেই সুবাদে মোহনবাগানের সঙ্গে আমাদের যে খেলাটা হয়েছিল সেই খেলা আকাশবাণী থেকে রিলে করেছে এই বলে যে, বাংলাদেশ একটা দেশ। সেই দেশের জাতীয় ফুটবল দল আজকে এই মাঠে খেলবে। এই যে প্রচারটা এটা সারা বিশ্ববাসীর কাছে আমরা করতে পেরেছি। সেটা হল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
জার্সির কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমার কাছে একটা জার্সি ছিল। সেই জার্সিটা আমার বাড়ির মানুষ (সহধর্মিণী) খুব যত্ন করে রেখেছে। এটা আমাদের একটা জাতীয় সম্পদ। এটা শুধু ফুটবলের সম্পদ না, এটা মুক্তিযুদ্ধের সম্পদ।
(৪)
মুক্তিযোদ্ধা এনায়েতুর রহমান বলছিলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আগরতলা গিয়েছিলাম। পথিমধ্যে সুভাষ বলেছে, আমরা যেভাবে সীমান্ত পার হয়েছি সেটা বেশ কঠিন ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকা থেকে ৭০ মাইল পায়ে হেঁটে আগরতলা পৌঁছি। আগরতলাতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে যোগদানের জন্য তখন আমি আবদুল কুদ্দুস মাখন ভাইয়ের কাছে গেলাম আমাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করার জন্য। সেখানে মাখন ভাই ছিলেন। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল যে আমরা আর্মস ট্রেনিং এ যাব। ওখানে যাবার পর কুদ্দুস ভাই বলল, তোমরা ইচ্ছা করলেই তো আমরা তোমাদের নিতে পারি না। সে জন্য একটা ব্যবস্থা আছে। তার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা যে ব্যবস্থাটা রেখেছি সেটা হচ্ছে- খেলোয়াড়, শিল্পী, শ্রমিক, ছাত্রদের জন্য আমরা বিভিন্ন ক্যাম্প করেছি।
মাখন ভাই বললেন, তুমি খেলোয়াড় ক্যাম্পে যাও। তারপর ট্রেনিং এর সময় আসলে তোমাদের নেওয়া হবে। ওই সময়ে কিছু দিন যাবার পর আগরতলায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে প্রক্রিয়াটা ছিল… আগরতলার যে ক্রীড়া সংগঠন তারা একটা ফুটবল খেলার আয়োজন করল আগরতলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। সেই ম্যাচ যেদিন খেলা হবে সেদিন ডেকোডা বিমানে আমাদের লুৎফুর রহমান, মুজিবর রহমান, মহসীন আলী, প্রতাপ শংকর হাজরা (আমাদের ভাইস ক্যাপ্টেন) উপস্থিত হলেন। ওই ম্যাচ খেলার পর আমাদের প্রতাপ দা ও লুৎফুর রহমান সাহেব বললেন, তোমাদেরকে কলকাতায় যেতে হবে। এ কথা শুনে আমি প্রথমে বললাম, আমি কলকাতায় যাব না। আমি যাব মুক্তিযুদ্ধে। আমি তো খেলতে আসিনি। তিনি বললে, তুমি যদি কলকাতা না যাও, তাহলে তুমি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিতে পারবে না। তুমি ইউ উইল বি অ্যারেস্ট অর সামথিং। কারণ এটা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আদেশ। সেই চিঠিটাও আমাকে দেখালেন।
এনায়েত বলেন, আমাদের আটজনকে সিলেক্ট করা হল। এরমধ্যে আইনুল ও বিমল বলল যে, আমাদের একটু সময় দিতে হবে। আমাদের নিজেদের একটা বিষয় আছে। আমরা ট্রেনে যাব। তাদের দুই জনকে রেখে আমরা আগরতলা থেকে কলকাতায় গেলাম।
বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে একটা সমঝোতার মাধ্যমে আমাদেরকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হল। আমরা জয়েন করলাম।
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিভিন্ন সময় শুনতে পাই, আমরা নাকি মুক্তিযোদ্ধা নয়, আমরা নাকি খেলোয়াড়। আমরা এতে জয়েন করেছিলাম সরকারের নির্দেশে। খেলোয়াড় হিসেবে আমরা যখন জয়েন করি তখন প্রথম দিনের খেলার যে বিষয়টি আমাদের সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করেছিল সেটা হচ্ছে, আমাদের টিম ম্যানেজার ও খেলোয়াড়রা বলেছিল আমরাদের জাতীয় সঙ্গীত যদি না বাজাও ও জাতীয় পাতাকা না উড়াও তাহলে আমরা খেলব না। এ নিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট সময় অতিক্রম হয়েছিল। তারা বাধ্য হয়েছিল আমাদের দাবি মেনে নিতে।
সবশেষে তিনি বলেন, আমাকে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন বা না দেন, সরকার বলুক বা না বলুক, আমি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা।
এনএইচবি/এএস