চিংড়ি নাকি ক্যান্সারের উপাদান খাচ্ছি?
বাজারে হঠাৎ করে আবার ভেজাল চিংড়িতে সয়লাব। অনেক ক্রেতাই প্রশ্ন তুলেছেন টাকা দিয়ে চিংড়ি কিনে খাচ্ছি নাকি ক্যান্সারের উপাদান খাচ্ছি। তাদের এই কথার যুক্তিও রয়েছে।
পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন চিংড়িতে যে জেলি মেশানো হয় সেটা মূলত প্লাস্টিক বা রাবার জাতীয় পদার্থ। এটি মূলত চিংড়ি মাছের ওজন বাড়াতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। জেলি মেশানো চিংড়ি খেলে ক্যান্সারের পাশাপাশি কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন চিকিৎসকরা।
বাচ্চাদের পছন্দের খাদ্য তালিকার প্রথম দিকেই রয়েছে চিংড়ি মাছ। সে যেভাবেই হোক চিংড়ি রান্না করে দিলে অধিকাংশ বাচ্চা তৃপ্তিসহকারে খেয়ে থাকে। এর ব্যতিক্রম নয় আমার সাড়ে সাত বছরের সন্তানও। তার পছন্দ অনুযায়ী মাছ কেনা আমার অন্যতম দায়িত্ব। তবে মাছ কেনার আগে সব সময় মাথায় থাকে নির্ভেজাল মাছ কোনো বাজারে পাওয়া যাবে। এ জন্য যখনই মাছ কিনতে যাই ঘুরে ঘুরে দেখার চেষ্টা করি। রাজধানীর তিনটি বাজারের কথা অন্তত বলতে পারি যেখানে চিংড়ি মাছ কিনে ঠকীনি এই গ্যারান্টি দিতে পারব না। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, আদাবর-৬ কাঁচাবাজার ও বেড়িবাঁধ নামার বাজার এই তিন বাজারের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।
সবশেষ বেড়িবাঁধ নামার বাজারের অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে শুরু করি। গত ৮ মার্চ সকালে নামার বাজার ঢুকেই প্রথমে রুই মাছ কিনলাম। এরপর মুরগি (পাকিস্তানি) কেনার জন্য এক দোকানে যাই। সেখান থেকে এক হালি মুরগি কেনার পর প্রসেসিং করতে দেই। তখন মুরগি দোকানির কাছে জানতে চাইলাম এই বাজারে জেলিমুক্ত চিংড়ি কোন দোকানে পাওয়া যাবে? অল্প সময় নিয়ে তিনি দেখালেন তার সামনেই এক হুজুর বসেন সেখানে নির্ভেজাল চিংড়ি পেতে পারেন। মুরগির দোকান থেকে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি মুখে দাঁড়িভর্তি এক মাছ বিক্রেতা তার মাছগুলো ডালিতে সাজাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে প্রথমেই বললাম ভাই দাম যাই হোক জেলিমুক্ত চিংড়ি চাই। জবাবে বললেন, আমি দেখে এনেছি আপনিও দেখে নেন, চিংড়ির ভেতরে তো যেতে পারব না।
মাছ বিক্রেতার এই কথা কিছুটা আশস্থ হলাম। কারণ অন্য দুই বাজারের যখন চিংড়ি কিনেছি একই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে মাছ বিক্রেতা বলেন, জেলিযুক্ত মাছ বিক্রি করি না। জেলিযুক্ত মাছ এই বাজারে নাই। দেখাতে পারলে সব মাছ ফেলে দেব এরকম চটকদার কথা বলেন। কিন্তু নামার বাজারের ওই বিক্রেতা (নাম জিজ্ঞাসা করিনি) বললেন আমি দেখে এনেছি আপনিও দেখে নেন। তাতে অন্তত বোঝা গেল থাকলেও থাকতে পারে তবে সে দায় নেবে না। এরপর চিংড়ি হাতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলাম। একটি চিংড়ির মাথার নিচের অংশে আঙ্গুল দিয়ে জেলির মতো কিছু একটা দেখতে পেলাম তাকে বললাম এই যে জেলি জবাবে তিনি বললেন জেলি কোথায় পেলেন? এটা তো মাছের মাংস কেটে আসছে। এরপর কিছুটা কথা চালাচালি চলে পরে মনে হলো লোকটা এত করে যখন দায়িত্ব নিয়ে বলছে অন্তত অল্প করে হলেও নিয়ে যাই।
এরপর ওই মাছ বিক্রেতাকে বললাম ঠিক আছে আপনি যেহেতু আশস্থ করছেন তাহলে আঁধা কেজি দেন। পরে গুণে গুণে কয়েটা চিংড়ি দিলাম ডিজিটাল ওজন মেশিনে দেখালেন ৫০৩ টাকা দাম হয়েছে। বড় সাইজের এই চিংড়ি ছিল সাড়ে ৭০০ টাকা কেজি। এরপর ৫০০ টাকা দিয়ে চিংড়িগুলো কিনে বাসায় ফিরলাম। মনে মনে ভাবতে থাকলাম যাক আজকে অন্তত মেয়েটাকে বলতে পারব তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ এনেছি। কিন্তু এবারও সেই হতাশা নিজ হাতে চিংড়িগুলো কাটলাম। কাটতে গিয়ে যখন মাথা পরিষ্কার করতে যাই মাথার খোলসের ভেতর স্তরে স্তরে জেলি, শুধু তাই না পুরো মাথায় মগজ তো নাই শুধু জেলি আর কোনো কোনটা ছোট ছোট সুজি জাতীয় দানা। এগুলো দেখে খুব কষ্ট পেলাম ভাবলাম এবারও ধরা খেলাম।
এটা গেল নামার বাজারের সব শেষ অভিজ্ঞতা। এর আগে কৃষি মার্কেটে কয়েক দোকান ঘুরে এক কেজি চিংড়ি কিনলাম। বাসায় গিয়ে চিংড়ি রাখতেই গৃহিনী বললেন আজও ধরা খেয়েছ। এত চিংড়ি কেন এনেছ? একদিনও তো মেয়ে খেতে পারে না এসব ভেজাল খাওয়ালে তো তোমার মেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। এই কথা শুনে নিজেকে অনেকটা অপরাধী মনে হলো। টাকা দিয়ে মাছ কিনলাম নাকি প্রজন্ম ধ্বংসের মরণাস্ত্র কিনলাম। কারণ এর আগে আদাবর বাজার থেকে চিংড়ি আনার পরও জেলি পেয়েছি।
সব শেষ ৮ মার্চ চিংড়ি কেনার পর নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু এই সিস্টেম বদলানোর ক্ষমতা আমার হাতে নেই তাই নিজেকে বদলে ফেলি। চিংড়ি আর কিনব না। চিংড়ি কিনলেও অন্তত বড় সাইজের চিংড়ি না। কারণ জেলি মেশানো হয় মূলত এই বড় চিংড়িগুলোতে। ছোট যে চিংড়ি সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনোদিন জেলি দেখিনি।
চিংড়িতে জেলি মেশানোর বিষয়টি স্বীকার করে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এটা উৎসে অর্থাৎ যেখানে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে সেই সকল এলাকাতে ঘরে ঘরে জেলি মেশানো হচ্ছে সেই খবর পাচ্ছি। এটা বন্ধ করতে হলে সামাজিকভাবে সোচ্চার হতে হবে। আমরা বাজারে বাজারে প্রচারণা চালাচ্ছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে সব কিছু বিবেচনা করে কাজ করতে হয়।
চিংড়ির বড় মার্কেট রপ্তানি। এ কারণে অভিযানে আগ্রহ একটু কম বলেও জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, চিংড়ি আমরা রপ্তানি করি। খুব বেশি নেতিবাচক প্রচারণা হলে রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়তে পারে। তারপরও দেশের মানুষকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিতে পারি না। এজন্য সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
জেলির ক্ষতি নিয়ে পুষ্টিবিদরা যা বললেন
ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে জানিয়ে পুষ্টিবিদ ইমদাদ হোসেন শপথ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, মূলত মাছের ওজন বাড়ানোর জন্য জেলি দেওয়া হয়। দেখা গেছে বড় সাইজের চিংড়িতে ১০০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত জেলি পাওয়া যায়। যে জেলি পাওয়া যায় পুরোটাই প্লাস্টিক জাতীয় উপাদান। তা ছাড়া অনেক সময় সাদা পাথরও দেওয়া হয়। চিংড়িতে যে জেলি দেওয়া হয় মূলত রাবার জাতীয় পদার্থ। যে কোনো রাবার, প্লাস্টিক বা ইথিলিন প্রথমত আক্রমণ করে কিডনিতে। এই প্লাস্টিক তাৎক্ষনিকভাবে কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হল যেহেতু প্রতিটি খাবার পাকস্থলীতে হজম হয়। কাজেই পাকিস্থলীতে যখন অপ্রত্যাশিত কোনো উপাদান প্রবেশ করে সেটাকে হজম করতে পারে না। ফলে আমাদের হজমের সমস্যা হয়। আর পাকস্থলী যখন স্বাভাবিকভাবে নেবে না তখন কোষগুলা নষ্ট করে শেষ পর্যায়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে।
ফরাজী হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান রুবাইয়া রীতি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চিংড়িতে যে জেলি পাওয়া যায় এটা মারত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কিডনির পাশাপাশি অন্যান্য জটিলতা দেখা দেবে। চিংড়ির জেলি ক্যান্সারের রূপান্তর করতে পারে।
এসএম/এমএমএ/