মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
সচল ট্রাইব্যুনাল, স্থবিরতা আপিলে
ছবি : সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করোনাক্রান্তির পর সচল হয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তিতে স্থবিরতা কাটেনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
মহামারি করোনাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতির মৃত্যু হয়। যার ফলে করোনার প্রভাব কমে আসার প্রেক্ষিতে বিচারাঙ্গণে গতি ফিরলেও গতিহীনই ছিল ট্রাইব্যুনাল। তবে গত ১৪ অক্টোবর একজন বিচারপতিকে ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর পূর্ণতা পায় তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে একটি রায়ও দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
এর প্রেক্ষিতে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার অমিত কুমার দে ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি যোগদান করার পর এখন ট্রাইব্যুনালের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে।
তবে করোনার রেশ কমে গেলেও ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে হওয়া আপিল মামলার ক্ষেত্রে স্থবিরতা অব্যাহতই আছে। যদিও ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এসব রায়ে অনেক আসমিই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তবে সর্বোচ্চ আদলত বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডের আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পুরাতন মামলাগুলোকেই প্রধান্য দিচ্ছে বলে জানা গেছে। তা ছাড়া আপিল বিভাগে বিচারক সংকটও প্রবল।
আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চে বিচারিক কার্যক্রম চললেও বর্তমানে চলছে মাত্র একটিতে। তা ছাড়া আগামী ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, তাতে আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা কমে হবে মাত্র চারজন। যদিও আপিল বিভাগে এক সময় ১১ জন বিচারপতিও ছিলেন।
আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধীদের অনেক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে বুধবার (১৫ ডিসেম্বর) অ্যাটর্নি জেনারেল, আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত অনেক মামলার শুনানি হয়েছে। বাকিগুলোর শুনানিও হয়ে যাবে। খুব দ্রুতই শুনানি হবে। (সুপ্রিম কোর্টের আসন্ন অবকাশ শেষে) খোলার পর শুনানি হবে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ যাবত ৪৩টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে। এসব মামলার রায়ে ৭২ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড, ২২ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং খালাস পেয়েছেন একজন। তবে এসব রায়ের মধ্যে যেগুলোর বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে তার মধ্যে মাত্র সাতটির আপিল নিষ্পত্তি করেছে সর্বোচ্চ আদালত। বাকি আরও ২৭টি মামলা আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানল এ যাবত ১১৬ আসামির বিষয়ে রায় দিয়েছে। যাদের মধ্যে ১২ জন মামলার রায় হওয়ার আগেই মারা গেছেন। বাকি ১০৪ আসামির মধ্যে ১০৩ জনকে দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আর বাকি একজন মো. আব্দুল লতিফকে শিশু বয়স বিবেচনায় খালাস দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান এসব তথ্য দিয়ে ঢাকাপ্রকাশকে জানান, রায় হওয়ার আগে মারা যাওয়া ১২ জনের মধ্যে ১০ জন মারা যান কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। আর অন্য দুইজন মারা যান পলাতক অবস্থায়।
প্রসিকিউশনে সংরক্ষিত তথ্য থেকে তিনি জানান, আসামিদের মধ্যে ৫২ জন আটক এবং ৫২ জন পলাতক। দণ্ডপ্রাপ্ত ১০৩ আসামির মধ্যে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৪ জন। সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসমি ৬ জন, যাদের মধ্যে ২০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত নোয়াখালীর আব্দুল কুদ্দুস বর্তমানে মৃত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আটক হয়েছেন ৩৫ জন এবং পলাতক ৩৬ জন। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আটক আসামিদের মধ্যে পলাতক ১১ জন এবং আটক ১১ জন।
আপিল নিষ্পত্তি
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হওয়া আসামিদের অনেকেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন। এর মধ্যে ৯ জনের আপিল নিষ্পত্তি করেছে সর্বোচ্চ আদালত।
রিভিউ
এদিকে সাড়ে ছয় বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও আপিল বিভাগে চুড়ান্ত নিষ্পত্তির (আপিল রিভিউ) অপেক্ষায় আছে দুটি মামলা। এই দুই মামলার আসামিরা হলেন সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার এবং জামায়াত নেতা এটিএম আজহার। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। পরে তারা ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করে।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে যাদের
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ যাবত ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই ছয় মামলার আসামিরা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দলটির আরও তিন কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলী, আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
আমৃত্যু কারাদণ্ড
এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল রিভিউ নিষ্পত্তি হয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনজন। তারা হলেন জামায়াতে ইসলামীর দুই কেন্দ্রীয় নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও এটিএম আজহার এবং জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার।
মৃত্যুর কারণে আপিল বাতিল
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া উপরিউক্ত ৯ আসামি ছাড়া আরও তিন আসামির আপিল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল করলেও আপিল নিষ্পত্তির আগেই মারা যাওয়ায় তাদের আপিল আবেদন বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালত। এই তিন আসামি হলেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম এবং জামায়াতের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সোবহান।
আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ২৭ মামলা
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৭ মামলার আসামিদের করা আপিল সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারাধীন এসব মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন। জাপার সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল জব্বার (রাজ্জাক), চাপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান মো. আকরাম হোসেন, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, নেত্রকোনার ওবায়দুল হক, আতা উর রহমান, মজিবুর রহমান, মহিবুর রহমান, সামসুদ্দিন আহমেদ, শাহসুল হক, এস. এম. ইউসুফ আলী, মো. সাখাওয়াত হোসেন, বিল্লাল হোসন, মো. আব্দুল লতিফ, ইউনুছ আহমেদ, মো. আমির আহম্মেদ, মো. জয়নুল আবেদীন, মো. আব্দুল কুদ্দুস, হামিদুর রহমান আজাদ, এ গনি ওরফে এ গনি হাওলাদার, মো. ইসাহাক সিকদার, মো. আব্দুল কুদ্দুস, মো. রনজু মিয়া, মো. খলিলুর রহমান মীর।
এমএ/টিটি/