বিএনপির জাতীয় সরকার ভাবনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ
আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে জাতীয় সরকার গঠন করবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সে লক্ষ্যে জাতীয় সরকার গঠনের ‘রূপরেখা’ দিয়েছে দলটি। তাদের এই ‘রূপরেখা’ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। তবে বিএনপির ওই রূপরেখা আওয়ামী লীগের ভাবনাতেই নেই। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনে করছে এটা তাদের রাজনৈতিক স্ট্যান্ড। বিএনপির এই প্রেসক্রিপশন জনগণ খাবে না বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
টানা দীর্ঘদিন রাষ্ট্র পরিচালনার বাইরে থাকায় বিএনপি নিজেদের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঠিক করতে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপরেখা নিয়ে আসছে। এবার বিএনপির প্রধান টার্গেট সরকার বিরোধী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাবের রাজনৈতিক দলগুলোকে কাছে টানা। সেই ধারণা থেকে নতুন টোপ দিয়েছে বিএনপি। অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলো যারা দীর্ঘ দিন রাজনীতি করলেও রাষ্ট্রক্ষমতার আশপাশে যেতে পারেনি তারাই হবে বিএনপির প্রধান তুরুফের তাস।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন এটা নতুন কিছু না। জাতীয় সরকার হোক আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হোক নির্বাচনটা হতে হবে সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন। সেক্ষেত্রে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক তাদের ভূমিকা হতে হবে পক্ষপাতহীন। গণতন্ত্রের পাহারাদার হচ্ছে জনগণ। আর সেই জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত রাজনৈতিক দল। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই কোনো সরকার গণতান্ত্রিক পথে হাটতে পারে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এজন্য নির্বাচনকালীন সংশ্লিষ্ট সব মহলের ভূমিকা হতে হবে পক্ষপাতহীন।
বিএনপির জাতীয় সরকারের ধারণা হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপিসহ মিত্রজোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন হবে। নির্বাচনে মিত্র-দলগুলো জিতলেও সরকারে থাকবে, হারলেও থাকবে। অর্থাৎ নির্বাচনে যদি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা হেরেও যান, তবু তাদের জাতীয় সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বিএনপির এই প্রস্তাবনায় স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে মিত্রদলগুলো। বিশেষ করে বিএনপি দলীয় জোটের সঙ্গে যারা আছেন তারা জাতীয় সরকারের রূপরেখাকে টার্গেট ধরে রাজনৈতিক মাঠ গরম করার চেষ্টা করছেন। তবে যাদের মাথায় বিষয়টি বেশি থাকা দরকার তাদের ভাবনাতেই নেই। বিএনপির এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি নেতাদের জাতীয় সরকারের ভুত মাথায় ঢুকেছে, আসলে বিএনপি কি চায় তা নিজেরাও জানে না। তাই বিএনপি নেতাদের বলব, এদিক-ওদিক না ঘুরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিন, অনেক ষড়যন্ত্র করেও গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোনো লাভ হয়নি। বাকি সময়েও লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও একইভাবে যথাসময়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনগণ যাকে চাইবে সেই ক্ষমতায় আসবে।’
বিএনপির জাতীয় সরকার ভাবনা আওয়ামী লীগের চিন্তাতেই নেই বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির একাধিক নেতা। তারা মনে করেন এটা রাস্তার আলোচনা। এগুলো নিয়ে বেশি দূর আগানো যাবে না। তারা যে স্বপ্ন দেখাচ্ছে তাতে জনগণের অংশগ্রহণ কোথায়? জনগণ কি বিএনপির জাতীয় সরকার নিয়ে ভাবছে, প্রশ্ন আওয়ামী লীগ নেতাদের।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, জাতীয় সরকারের কোনো কনসেপ্ট আমরা বিশ্বাস করি না। জাতীয় সরকারের কোনো কনসেপ্ট সংবিধানে বিদ্যমান নেই। সুতরাং প্রশ্নই ওঠে না। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। নির্বাচনে সবাইকে আসবার আহ্বান জানাই গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে সমুন্নত রাখার জন্য। আমরা নাকচ করে দিয়েছি।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘বিএনপি কত কিছুই পরিকল্পনা করে। দেখতে হবে তারা যা চায় তাতে কি দেশবাসীর সায় আছে? জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে? তারা যেটা বলেছে সেটা গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন, নাকি বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজন, কোনটা তাদের উদ্দেশ্য? রাজনৈতিক ফায়দা লুটা। বিএনপির প্রত্যেকটা কাজই থাকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটা। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আরও শক্তিশালী হবে।’
বিএনপির এই ফরমুলা নিয়ে আওয়ামী লীগকে চিন্তায় ফেলল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের (বিএনপি) কর্মকাণ্ড তাদেরই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তাদের অপরাজনীতির কারণে আস্তে আস্তে বিস্মৃতির তলায় হারিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ দেশের স্বার্থে রাজনীতি করে এদেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে সুতরাং বিএনপির ফর্মুলায় আওয়ামী লীগের সংশয়ের কোনো কারণ নেই। অপরাজনীতির সঙ্গে বা অপরাজনীতিবিদদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কখনই আপোষ করেনি, করবেও না। কাজেই আওয়ামী লীগের সংশয় বা দুশ্চিন্তার কিছু আছে বলে আওয়ামী লীগ কখনই মনে করে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘জাতীয় সরকারের এটা নতুন কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হলে এক পক্ষের মতো করে হবে না। কোনো একটা দল ৫০ বছর ক্ষমতায় আছে এই জন্য তাকে ফেলে দিতে হবে এটা কোনো কাজের কথা না। কিংবা কোনো একটা বিরোধী দল অনেক বছর ক্ষমতার বাইরে আছে তাকে ক্ষমতায় নিতে হবে এটাও বিবেচ্য না। বিবেচ্য হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, জনগণ যাকে খুশি তাকে নির্বাচিত করবে, এটাই হলো কথা। সর্ব মহলকে চেষ্টা করতে হবে ২০২৩ সালে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং বৈশ্বিকভাবে পরীক্ষিত স্বীকৃতি গণতান্ত্রিক ইতিহাসে যেভাবে নির্বাচন হয় সেই কাঠোমতে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপির জাতীয় সরকার পরিকল্পনা ‘এটা এ পর্যন্তই’। জাতীয় সরকারই করতে হবে কেন? বাংলাদেশে তো গৃহযুদ্ধ হচ্ছে না।’
এসএম/আরএ/