বসবাসের অযোগ্য ঢাকা
পরিত্রাণের উপায় নিয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ঢাকা। সবদিক থেকেই শহরটির অবস্থা মৃতপ্রায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে, বসবাসের অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৪ নম্বরে।
ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলছে, ঢাকার চেয়ে খারাপ অবস্থা শুধু পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি, নাইজেরিয়ার লেগোস এবং সিরিয়ার দামেস্ক। ১০০ এর মধ্যে ঢাকা পেয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৫।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবগুলো সূচকেই ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ। যানজট দিনের পর দিন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে ২০২৫ সালে গাড়ির গতি হাঁটার গতির চেয়েও কম হবে। ঢাকা শহরের পরিবেশ বিশ্বের অন্য শহরগুলোর চেয়ে সবচেয়ে খারাপ। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ঢাকা শহর শীর্ষে অবস্থান করছে। সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও নাগরিকদের আয়ের নিশ্চয়তা দিন দিন কমছে।
এখন ঢাকার বাসযোগ্য ফিরিয়ে আনার উপায় নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। বৃহৎ প্রকল্পগুলো নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। প্রকল্পগুলো করা যুক্তিসঙ্গত নাকি বৃত্তাকার রেলপথ ও নৌপথ করে দিলে ঢাকার ওপর চাপ কমত এমন কথাবার্তাও হচ্ছে।
যানজট নিরসনে বড় প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন
যানজট নিরসনে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ফ্লাইওভার করা হয়েছে। মেট্রোরেল করা হচ্ছে। কিন্তু যানজট পরিস্থিতি দিন দিন খারাপই হচ্ছে। এখন অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, বড় বড় প্রকল্পগুলোর আদৌ দরকার ছিল কীনা। খোদ সরকারি লোকজনই এমনটা বলছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলছেন, যানজট নিরসনে পরিকল্পনামাফিক আগানো হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বনানীর যানজটের কারণ হিসেবে দুটি সরকারি ভবনকে দায়ী করে তিনি বলছেন, সেতু ভবন ও বিআরটিএ ভবন কেন রাস্তার ওপরে? এই ভবন দুটোর কারণে যানজট লেগে থাকে এই এলাকায়।
সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, সবচেয়ে অযোগ্য, সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা। দুটি অপবাদ ঘাড়ের ওপর। এটাকে মাথায় রেখেই ঢাকাকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। ঢাকা শহর নিয়ে আমাদের লজ্জায় থাকতে হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যেকোনো শহরে রাস্তা থাকতে হয় ২৫ ভাগ। কিন্তু ঢাকায় রাস্তা আছে মাত্র ৮ ভাগ। এই ৮ ভাগেরও অর্ধেক অব্যবহৃত থাকে দখল ও অবৈধ পার্কিংসহ নানা কারণে। এছাড়া ফুটপাত দখলে থাকার কারণে পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। এটাও যানজটের একটি কারণ।
ঢাকা শহরের মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষের জন্য রাস্তা নষ্ট করে মেট্রোরেলের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম পাতাল রেলেও পর একটি অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন, ২০২৫ সালে গাড়ির গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম হবে। একটি শহরের জন্য ফুটপাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মেট্রোরেলের সিঁড়ি কীভাবে ফুটপাতে ওপর হতে পারে? যে কনসালট্যান্ট এগুলো করেছেন তিনি সরেজমিন যাননি।
মেট্রোরেলের এমন ডিজাইন পরিবর্তন করার দাবি জানিয়ে মেয়র বলেন, ফুটপাতে মেট্রোরেলের কোনো ধরনের ল্যান্ডিং হতে পারবে না। নিরাপদ ফুটপাতে বিঘ্ন ঘটবে। এর চেয়ে প্রথমেই যদি মাটির নিচ দিয়ে পাতাল রেল করা যেত। তাহলে রাস্তার জমি নষ্ট হতো না।
বিকেন্দ্রীকরণ এবং ঢাকা ঘিরে রেল ও নৌপথের ওপর গুরুত্ব
ঢাকা শহরে নানা ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে ঢাকা থেকে মানুষের চাপ কমানোকে সমাধান বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে অফিস সময়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে ট্রেনের ব্যবস্থা করলে ঢাকার আশাপাশের জেলায় চলে যেত মানুষ। অর্থাৎ রেলপথের আধুনিকায়ন করলে ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমত।
সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দেওয়া হলে ঢাকা শহর ছাড়ত মানুষ এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এক্ষেত্রে বৃত্তাকার নৌপথ ও বৃত্তাকার রেলপথ খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের যে মনোযোগ সে তুলনায় এই উদ্যোগুলো নিয়ে কেন জানি কথা খুব কম হয়।
পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বৃত্তাকার নৌপথ করতে গেলে আমাদের যে সুবিধা ছিল সেটা হলো ঢাকার চারপাশেই নদী রয়েছে। ঢাকা শহরের চারপাশ ঘিরে আছে ৬০ কিলোমিটারেরও বেশি নদনদী। অন্যান্য বড় শহরে নদী থাকে একটি কিন্তু ঢাকায় নদী রয়েছে চারটি। কিন্তু নদীগুলো দখলে-দূষণে জর্জরিত।
দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা ঘোষণা করে হাইকোর্ট একটা রায় দিয়েছিল। কিন্তু সেই রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই। বিআইডব্লিউটিএ শুধু নদীর দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও নদী দূষণ এবং ময়লা অপসারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই কোনো পদক্ষেপ।
ক্লিন রিভার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সোহাগ মহাজন এ প্রসঙ্গে ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, হাইকোর্ট ১৭টি দিকনির্দেশনা দিয়েছিল এবং সেটি ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু একবছরে বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
বিভিন্ন সময় বুঙিগঙ্গার দূষণরোধ এবং ময়লা অপসারণে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা শুরু না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বর্জ্য অপসারণ এবং নদীর সঙ্গে সংযুক্ত স্যুয়ারেজ লাইন অপসারণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন তারা।
বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের নতুন সদস্যসচিব মিহির বিশ্বাস ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আদালত পর্যন্ত নির্দেশ দিয়েছে এবং তাদের সময় বেঁধে দিচ্ছে যে এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্তত এই কাজটুকু করুন। তারপরও আমরা দেখতে পাই সেটুকুও করা হয় না।
একই অবস্থা ঢাকার চারপাশ ঘিরে থাকা বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীরও। শতবছর আগের নদীর সিএস জরিপ অনুযায়ী যে সীমানা ছিল দখলদারিত্বের কারণে তার এখন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। বুড়িগঙ্গা ও বালু নদের সীমানার মধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপনা।
বিভিন্ন ভবন গড়ে তোলা হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে। আর তুরাগ দখল করে গড়ে উঠেছে একের পর এক ইটভাটা। নদীর পার দখল করে বসতবাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিআইডব্লিটিএ উচ্ছেদ করে দিলে কয়েকঘণ্টা পর আবার দখল হয়ে যায়।
সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বায়ু দূষণ রোধে তৎপর হওয়ার উপর গুরুত্ব
বায়ু দূষণে শীর্ষে থাকার দিল্লির পরে দ্বিতীয় স্থানে আছে ঢাকা। পরিবেশবিদরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে দূষণের কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেবে। দূষণের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, বায়ুদূষণকে এখনই প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণজনিত কারণে মারা যাচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এই অবস্থাটি একদিনে হয়নি। নির্মাণকাজ করার সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনাটিও উপেক্ষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণকে অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
সবচেয়ে দূষিত শব্দের শহর ঢাকা
সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শব্দ ঢাকা শহরে। শব্দ দূষণে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। শহরের বাসিন্দারা শব্দদুষণজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।
সড়কে যারা নিয়মিত বের হন তারা ভয়াবহ শব্দ দূষণের শিকার। শিশু আর বৃদ্ধরা ভোগেন সবচেয়ে বেশি। এদের কেউ কেউ ভুগছেন দীর্ঘস্থায়ী শ্রবণসমস্যায়। কারও কারও চিরসঙ্গী হচ্ছে মাথাব্যথা।
বাংলামটর মোড়ে কথা হয় স্কুলশিক্ষার্থী অন্তুর সঙ্গে। সে জানায়, তার মাঝে মাঝে মাথাব্যথা করে শব্দের কারণে। বাংলামটর মোড়েই সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা লাব্বাইক বাসের চালক শহিদ বলেন, হর্ন দেই নানা কারণে। কিন্তু আমার নিজেরও মাথাব্যথা করে হর্নের শব্দে।
এই শব্দের আগুনে ঘি ঢালছে হাইড্রোলিক হর্ন। নিষিদ্ধ হলেও যানবাহনগুলো হাইড্রোলিক হর্নই বেশি। এ ব্যপারে পুলিশ বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
এ ব্যপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. মাসুদ হাসান পাটোয়ারি বলেন, শব্দ দূষণ প্রতিরোধে অধিদপ্তর নিয়মিত মোবাইল কোর্ট চালাচ্ছে। আশা করছি দূষণের মাত্রা আস্তে আস্তে কমে আসবে।
নাগরিকদের রোজগার বাড়ানোর মতো প্রকল্প নিতে হবে সরকারকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও ৬ শতাংশ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে গেছে।
একদিকে, মানুষের আয় কমছে কিন্তু বাড়ছে ব্যয়। ফলে বেশি চাপে পড়ছেন স্বল্প আয়ের মানুষরা। ক্যাবের গবেষণা বলছে, ২০২০ সালেই রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং পানি ও গ্যাসের খরচ বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালের চালের দাম বেড়েছে ২০ ভাগ। এর সঙ্গে রয়েছে বাড়িভাড়া। গত ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৪০০ শতাংশ। ঢাকা শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশের উপরে ভাড়া থাকে। অথচ এ বিষয়ে সরকারের কোনো মনোযোগ নেই।
জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়রোজগারের ব্যবস্থা করা। বড় কোনো প্রকল্প নতুন করে গ্রহণ না করে যাতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, ভোক্তার আয়উন্নতি হয় সেইদিকে যেন নজর দেওয়া হয়।
তেল, চিনি বা নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো হুঁশিয়ারিই কাজে আসছে না। গত দেড় বছরে বাড়তি খরচ মেটাতে না পেরে ঢাকা ছেড়েছেন অনেকেই। গবেষণা বলছেন, দৈনন্দিন জীবনে শুধু খাদ্যপণ্যের পেছনেই বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে দরিদ্র মানুষকে।
আরইউ/