মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণমূলক কাজে গলদ
বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্য সন্তান। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরতে ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমান উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। যা তিন বছরে শেষ করার কথা। নিদিষ্ট সময়ে তো হয়নি, পাঁচবার সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয়েছে সাড়ে সাত বছর। ব্যয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ১৫ কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাড়ে ১০ বছর পর প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে গত জুনে; কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল স্থাপন না করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গলদ থেকে গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সম্প্রতি একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতেই এ প্রকল্পের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে।
- প্রকল্প পরিচালক ছিলেন ১৫ জন
- বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল স্থাপন হয়নি ৩ কমপ্লেক্সে
- নষ্ট হয়ে গেছে নাটোর কমপ্লেক্সের টাইলস
- ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে দুটির
উল্লেখ্য, জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণীয় করে রাখতে প্রথমে ৪৮ জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জন্য ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন দেয় সরকার। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তর।
মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুসারে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি বাড়িয়ে ধরা হয় ১৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা। সর্ব শেষ প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে ২৬৭ শতাংশ, আর ব্যয় বাড়ে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় হয় ১৩৩ কোটি টাকা বা ৮৭ শতাংশ।
সব জেলায় একটি করে পাঁচতলা বিশিষ্ট ভবনের উপর তিনতলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরমধ্যে নিচতলায় দোকানের মাধ্যমে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা, দ্বিতীয় তলায় কমিউনিটি সেন্টার ও তৃতীয় তলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসের ব্যবস্থা করা।
প্রথমে শুধু প্রকল্প পরিচালকের রুমে যন্ত্রপাতি রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরে সংশোধনের সময় সব উপজেলা কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি ও ফার্নিচার, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের বই ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ২০১১ সালের ২ মে থেকে ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ মজিবুল হক। আর ২০২০ সালের ১৭ আগষ্ট থেকে ১৫তম পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপ-সচিব ড. সৈয়দ শাহজাহান আহমেদ।
কাজের গুণগত মান দেখার জন্য মন্ত্রণালয়ে বছরে চারটি করে পিআইসি ও পিইসি মিটিং করার কথা। কিন্তু গত ১০ বছরে মাত্র ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও ৮টি প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিইসি) মিটিং হয়েছে। এরফলে প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়ে গেলেও গলদ থেকে গেছে কাজে। তৃতীয় তলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অফিস করা হলেও ওঠানামার জন্য কোনো লিফটের ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রকল্পের পরিকল্পনাতেই ত্রুটি ধরা পড়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া বারবার প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সিলেট মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে টেন্ডার ডকুমেন্টের চেয়ে বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এই কমপ্লেক্সটি ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মাণ করায় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। অথচ ঠিকাদারকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কমপ্লেক্সের আসবাবপত্র দেখভাল করার কোনো লোকবল নেই।
বান্দরবান মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের নিচতলা থেকে তৃতীয় তলা ভবনের সম্পূর্ণ ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। লিফটের জায়গায় ওয়াল তুলে বন্ধ করা হয়েছে। ভবনের ভেতর-বাহিরের রং মানসম্মত না হওয়ায় দেয়াল থেকে তা খসে পড়ছে। ভবনে বৈদ্যুতিক ও পানির ব্যবস্থা নেই। দরজার পাল্লায় লম্বা ফাটল দেখা দিয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণে অভাবে সেনেটারী, প্লাম্পিং ও ফ্লোরের টাইলস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নাটোর কমপ্লেক্স ভবনের বিভিন্ন স্থানে টাইলসও ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে। মূল নকশা অনুযায়ী নিচ তলায় ৯টি দোকানের ব্যবস্থা করা হয়। কোনো কোনো ভবনে ১৯টি দোকান করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রেতা বা ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়নি।
রাজশাহী কমপ্লেক্সের নিচতলায় যাদের দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে তারা নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত অংশ বাড়িয়েছে। কক্সবাজার ও বান্দরবান কমপ্লেক্সের প্রথম থেকে তৃতীয় তলার সব ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও সিলেট, বগুড়া, সাতক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল স্থাপন করা হয়নি। রাজশাহী, মৌলভীবাজার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসহ অনেক ভবনে র্যাম নেই। শুধু তা-ই নয়, খুলনা কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তারপরও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, ভবনের সামনে যানবাহন পার্কিং করার জন্য কোনো জায়গাও নেই। যেসব ভবন ভাড়া দেওয়া যায়নি, সেসব ভবনের কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। অনেক ভবনে ইতিমধ্যে ফাটলও দেখা দিয়েছে। ২৫টি কমপ্লেক্সের মধ্যে ১২টি দোকান ফাঁকা পড়ে আছে। ২৫ জেলায় ১২ শ মুক্তিযোদ্ধা, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এতো গলদ কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আইএমইডি’র সদ্য সাবেক সচিব এবং পকিল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির বীর। তাদের কল্যাণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু ডিপিপি অনুযায়ী কাজ হয়নি। বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে। এটা দুঃখজনক। যারা এসব কাজ করেছে ঠিক করেনি। নিবিড় পরিবীক্ষণের মাধ্যমে প্রকল্পটির কোথায় কোথায় ত্রুটি ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে।’
প্রকল্প পরিচালক ড. সৈয়দ শাহজাহান আহমেদ বলেন, ‘প্রকল্প যখন শেষ পর্যায়ে তখন আমি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। আইএমইডি যে রিপোর্ট করেছে তা খারাপ হয়নি। তবে কিছু ক্ষেত্রে আমার দ্বিমত আছে। যেমন–ডিজাইনের ব্যাপারে যে ত্রুটি ধরা হয়েছে। যখন এটা প্রণয় করা হয়েছিল তখন বলা উচিত ছিল। কাজ শেষে বলে লাভ কী? আগেই মনিটরিং করা দরকার ছিল। রিপোর্টে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে সংশোধনের সুযোগ ছিল। কেন ঠিকমতো ডিজাইন করা হয়নি তাও আমার জানা নেই।’ পিসিআর রির্পোট হয়নি। তাই সব তথ্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরা হয়নি বলেও জানান তিনি।
এসএ/