চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী
'ইলেকশন আয়, আর আমরা নৌকায় ভোট দেই'। কারণ আমরা আপনার বাপেরে খুব ভালোবাসি। বাপ বাইচা থাকলে আইজকে আমাদের কথা বলার লাগতো নায়। আইজ বাপ বাইচে নেই,আপনি আছেন। আপনি আমাদের মা। আপনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। আমাদের কোনো দল নেই। শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীকে এভাবেই নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের চা শ্রমিক রিতা পানিতা। এ সময় রিতা পানিতা বলেন, শ্রমিকদের পক্ষে আপনাকে দেবার কিচ্ছু নেই মা। আপনাকে শুধু অনুরোধ করবো আমাদের বাগানে এসে একবার চা খেয়ে যাবেন।
চা শ্রমিকদের জন্য আজকের দিনটি ছিল একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী কথা বললেন চা শ্রমিকদের সাথে। ভার্চুয়ালি এই অনুষ্ঠানে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ দেশের চা বাগানগুলোর শ্রমিকরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে গিয়ে এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন চা শ্রমিকরা।
শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে ভার্চুয়ালি এই মতবিনিময় সভায় শুরুতেই কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর মৌলভীবাজার থেকে দুই নারী শ্রমিক কথা বলা শুরু করেন। জেলার কমলগঞ্জের পাত্রখোলা চা বাগানের দলই ক্লাব থেকে আয়োজিত অনুষ্ঠানস্থল থেকে রিতা পানিতা ও সোনমানি রাজ হংসিমান। বক্তৃতাকালে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এ দুই জন। ধরা কণ্ঠে চোখের জল ফেলে প্রধানমন্ত্রী এভাবে সরাসরি কথা বলায় তাঁরা অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানস্থল থেকে চা শ্রমিকদের গাওয়া রেকর্ডেড দুটি গান পরিবেশন করে প্রধানমন্ত্রীকে শুনানো হয়।
এদিকে সিলেটের লাক্কাতুড়া গলফ ক্লাব মাঠে চা শ্রমিকদের এই অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি ড. এ কে আব্দুল মোমেন, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ পিপিএম, জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন, সিলেট মহানগর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কনফারেন্সে চা শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে চা শ্রমিকদের কথা শোনার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজের ভাষণ দীর্ঘায়িত করেন নি। চা শ্রমিকদের মধ্য থেকে শুরুতেই কথা বলার সুযোগ পান কমলগঞ্জের মির্তিঙ্গা চা বাগানের ঋতা মানিকা। ঋতা মানিকা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকায় উত্তীর্ণ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন- 'আপনে আমাদের মা, আপনার কথা আমরা সবসময় ভাবি। আপনি যা বলবেন আমরা তাই শুনবো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো আপনিও আমাদের পাশে থাকবেন। আপনি আমাদেরকে কখনো ছেড়ে যাবেন না'।
কমলগঞ্জের দলই চা বাগানে চা শ্রমিকদের বৈঠকস্থলে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য, অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদসহ আওয়ামী লীগের আরও বহু নেতাকর্মীরা। এর আগে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ ভাষণের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে শহীদ চা শ্রমিকদের স্মরণ করেন।
বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা শ্রমিক এবং এই চা শিল্প নিয়ে কাজ করে গেছেন। দেশে চা নিয়ে কোনো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ছিলো বঙ্গবন্ধু শ্রীমঙ্গলে দেশের একমাত্র চা গবেষণা ইন্সটিটিউট গঠন করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারও আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- চা শিল্প আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। চা বাগান দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি এই চা শিল্প আমাদের অর্থখাতের জন্যও ভীষণ দরকারি। তাই এই চা শিল্প যেন ধ্বংস হয়ে না যায় সেদিকে আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য আমি আমার সকল চা শ্রমিক ভাইদেরকেও অনুরোধ জানাবো এই চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভার্চুয়ালি এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে সিলেটের চা শ্রমিকদের মাঝে ছিল আজ এক উৎসবমুখর দিন। চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা জানান, লাক্কাতুরা চা বাগানের গলফ মাঠে শামিয়ানা টানিয়ে অনুষ্ঠানস্থল সাজানো হয়েছে। স্থানীয় অতিথিরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারেন সে জন্য অনুষ্ঠানস্থলের চারদিকে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ফগার মিশিন দিয়ে মশকনিধন ওষুধ স্প্রে করা হয়েছে। এছাড়াও সিসিকের উদ্যোগে রাখা হয়েছে 'ভ্রাম্যমাণ পাবলিক টয়লেট'।
উল্লেখ্য, দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীতকরণের দাবিতে সিলেটসহ সারা দেশের চা শ্রমিকরা টানা ১৯ দিন আন্দোলন করেছেন। গত ৮ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন তারা। ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার আশ্বাসে গত ২২ আগস্ট শ্রমিকদের একাংশ আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফিরলেও আরেক অংশ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন।
চা শ্রমিকদের টানা ধর্মঘটে সারাদেশের বাগান থেকে চা-পাতা উত্তোলন, কারখানায় প্রক্রিয়াজাত ও উৎপাদন বন্ধ থাকে। এতে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের চা শিল্প। এ অবস্থায় গত ২৭ আগস্ট শনিবার বাগান মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। এ বৈঠকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আনুপাতিক হারে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হবে। সবমিলিয়ে দৈনিক মজুরি হবে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার পর ২৮ আগস্ট থেকে সিলেট বিভাগের সকল বাগানের চা শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন।
এএজেড