৩০০ কোটি টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ নওগাঁর ৮ সমবায় সমিতি!
৩০০ কোটি টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ নওগাঁর ৮ সমবায় সমিতি। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
পুকুরের মাছ, খেতের ফসল বিক্রি করে তিল তিল করে ১৬ লাখ টাকা জমিয়েছিলেন নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (৫০)। টাকাগুলো চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে কয়েক ধাপে দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সমিতিতে স্থায়ী আমানত হিসেবে জমা রেখেছিলেন।
৮ মাসের লভ্যাংশসহ তা বেড়ে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। কিন্তু দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি গত ২৫ অক্টোবর রাতারাতি বন্ধ করে পালিয়ে যান উদ্যোক্তারা। এত টাকার সঞ্চয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জাহিদুলের বৃদ্ধ মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
জাহিদুল বলেন, ‘সমিতি বন্ধ হয়ে খবর পাওয়ার পর আমার মা গত শনিবার স্ট্রোক করেন। স্ট্রোক করার পর এখনও মা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি। তিল তিল জমানো টাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নাওয়া-খাওয়া নেই। স্বপ্ন ছিল জমানো টাকা দিয়ে নওগাঁ শহরে কিছু জমি কিনে একটা বাড়ি করব। কিন্তু এখন আমি সর্বশান্ত। জায়গা-বাড়ি করা তো দূরের কথা এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে।’
দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিতে টাকা রেখে সঞ্চিত টাকা খুইয়েছেন নওগাঁ সদর, রাণীনগর, আত্রাই ও বদলগাছী উপজেলার অন্তত ৪০০ গ্রাহক। গ্রাহকের আমানতের ২২ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির কর্মকর্তারা।
শুধু দোয়েল সমিতিই নয়; গ্রাহকদের টাকা নিয়ে উধাও হচ্ছে অনেক সমিতি। এতে দরিদ্র মানুষ সমবায় সমিতির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার বদলে নিঃস্ব হচ্ছে। ভাঙছে তাঁদের স্বপ্ন।
একটি সরকারি অফিসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন শহিদুল ইসলাম (৬৫)। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পেনশন হিসেবে ৮ লাখ টাকা পান তিনি। দুই বছর আগে পেনশনের সমুদয় টাকা তিনি সুরমা মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী আমানত হিসেবে জমা রাখেন। প্রতি মাসে লাখে তিন হাজার টাকা করে মুনাফা দেওয়ার শর্তে তিনি ওই টাকা জমা রাখেন। টাকা জমা দেওয়ার পর থেকে প্রথম দিকে মাসে মাসে নিয়মিত লভ্যাংশ দিচ্ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে সমিতির কর্মকর্তারা লভ্যাংশ দেওয়া নিয়ে তালবাহানা শুরু করেন। এরমধ্যে গত মার্চ মাসে সমিতির নির্বাহী পরিচালক ছবেদুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা সমিতির কার্যালয়ে তালা দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। থানায় অভিযোগ করেও গত ৭ মাসেও সঞ্চিত টাকা ফেরত পানননি শহিদুল ইসলাম। একইভাবে ওই সমিতির চার শতাধিক গ্রাহকের অন্তত ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সমিতির নির্বাহী পরিচালক ছবেদুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
মাদারগঞ্জ উপজেলার মাহফুজা বেগম। সত্তরোর্ধ্ব এই নারী লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছেন টাকা আদায়ের মানববন্ধনে। ‘শতদল সমবায় সমিতি’তে রাখা টাকার জন্য ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। মাহফুজা বেগম বলেন, ‘৭০ হাজার টাকা তোলার কত চেষ্টা করলাম, তাও দিলো না। এখন আমার আছে শুধু এক আল্লাহ। আর কিছু নাই।’
একই অবস্থা সম্প্রতি বন্ধ হওয়া জগৎসিংপুর সূর্যমুখী বহুমুখী সমবায় সমিতির দুই শতাধিক গ্রাহকের। জগৎসিংহপুর এলাকার বাসিন্দা আকলিমা বিবি (৭০)। স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতার চার বছর ধরে ধাপে ধাপে জমা করেছিলেন ওই সমিতিতে। গত জুলাই মাসে সমিতির নির্বাহী পরিচালক মুকুল হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। এখন তিনি পাগল প্রায়।
আকলিমা বিবি বলেন, ‘সন্তান নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সূর্যমুখী সমবায় সমিতিতে টাকাগুলা জমা থুছিলাম। গত জুলাই মাসে হঠাৎ করে একদিন দেখি সমিতির অফিস তালা দেওয়া। পরিচালক মুকুল ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ নাই। মুকুলের বউ-ছাওয়ালও ভ্যাগে গেছে। এখন জমানো টাকা ফেরত ল্যাওয়ার জন্য থানা, ইউএনও অফিস ও ডিসি অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরোছি। কিন্তু কোনো কাম হছে না।’
শুধু আকলিমা, শহিদুল বা জাহিদুলই নয়, এমন হাজার হাজার মানুষের অন্তত ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা। সারাজীবনের কষ্টের টাকা হারিয়ে দিশেহারা মানুষগুলো। আত্রাই উপজেলার বান্দাইখাড়া এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘পরিবারের জন্যই তো টাকা জমা রেখেছিলাম। এখন তো প্রয়োজনের সময় টাকা না পেয়ে আমার পরিবারই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর নওগাঁয় জেলায় আটটি সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত না দিয়ে হঠাৎ করে কার্যক্রম বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে গেছেন। ওই আটটি সমবায় সমিতি হচ্ছে, নওগাঁ সদর উপজেলায় সুরমা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, ডলফিন সমবায় সমিতি, জগৎসিংহপুর সূর্যমুখী বহুমুখী উন্নয়ন সমবায় সমিতি, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন ও মেঘনা সেভিংস এন্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মহাদেবপুর উপজেলার ব্যতিক্রম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং মান্দা উপজেলার আল আরাফাহ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড। এসব সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচ হাজার গ্রাহকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। লাগাতার আন্দোলন ও মামলা করেও গ্রাহকেরা তাঁদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
আত্মগোপনে থাকা দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন মুঠোফোনে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর থেকে সমিতির সদস্যরা সবাই একসঙ্গে আমানতের টাকা ফেরত চাইতে শুরু করে। সবাই একসঙ্গে জমা টাকা ফেরত চাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যাই। গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক ও স্থায়ী আমানত হিসেবে আমার সমতিতিতে প্রায় ২১ কোটি সঞ্চয় আছে। সেই টাকা থেকে ১৬ কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের কাছ থেকে ঋণ দেওয়া আছে। সেই টাকা তুলতে না পারায় সদস্যদের টাকা ফেরত দিতে পারছি না। কিন্তু সদস্যরা তা মানতে চান না। টাকা না পেলে অনেকেই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। নিরাপত্তার কারণে গত শুক্রবার থেকে আমি আত্মগোপনে আছি। তবে প্রশাসন আমাকে নিরাপত্তা দিলে আমি এলাকায় ফিরে আমার সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের সব টাকা ফেরত দেব। কারও টাকা আত্মসাৎ করব না।’
ভুক্তভোগীরা জানান, জেলা ও উপজেলা কার্যালয় থেকে সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধন নেওয়ার পর সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তা বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের প্রলুব্ধ করে অবৈধভাবে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানত নামে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে টাকা রাখতে শুরু করে। টাকা জমা রেখে গ্রাহকদের প্রতি মাসে মুনাফা দিতে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। ধীরে ধীরে সমিতির গ্রাহকসংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এক সময় গ্রাহকদের আমানতের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা।
নওগাঁ জেলা সমবায় সমিতি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁর ১১টি উপজেলায় নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সংখ্যা ১ হাজার ৬২০টি। এর মাধ্যমে ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ৪৫০টি সমিতি।
গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা নিয়ে একের পর এক সমবায় সমিতির লাপাত্তা হওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন নওগাঁর সাবেক সম্পাদক বেলাল হোসেন বলেন, ‘প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমবায় কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের অসর্তকর্তার কারণে এসব হচ্ছে। এতে নিরীহ ও অসহায় মানুষ সমবায় সমিতির খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে। এসব সমস্যা উত্তরণে নিবন্ধন দেওয়ার আগে আরও ভালো করে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। নিবন্ধন দেওয়ার পর সমবায় কার্যালয়কে সমিতিগুলোকে ভালো করে মনিটরিং করতে হবে। এছাড়া প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তদারকি বাড়াতে হবে।’
গ্রাহকের টাকা সমিতির লাপাত্তা হওয়ার বিষয়ে জেলা সমবায় কর্মকর্তা খোন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নওগাঁতে ৪৫০টির মতো ঋণদানকারী সমিতির কার্যক্রম বর্তমানে চলমান আছে। এর মধ্যে কয়েকটি সমবায় সমিতি সম্প্রতি গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত না দিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে এসব সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সমিতির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে ও থানাতেও একাধিক মামলা চলমান আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই টাকা উৎপাদনশীল খাতে না খাটিয়ে অনেক সময় সমিতির কর্মকর্তারা জমিজমা কিংবা বাড়ি-গাড়ি কিনে থাকেন। এসব করতে গিয়ে সমিতিগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সমিতি পরিচালনার কারণে গ্রাহকেরা যখন লভ্যাংশ কিংবা আমানতের টাকা ফেরত চান তখন তাঁদের টাকা দিতে পারছে না সমিতিগুলো। আগামীতে কোনো সমবায় সমিতি যাতে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ানো হবে।’