১৪ বছরে ১৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়েও কাটেনি সিলেটের জলাবদ্ধতা
সিলেট নগরবাসীর অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। অল্প বৃষ্টিতেই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। এর কারণে ময়লা-অবর্জনার স্তুপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। বাসা-বাড়ি ও রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ভেসে উঠে আবর্জনার স্তুপ। সামনেই বর্ষার মৌসুম। অথচ বর্ষার আগেই জলাবদ্ধতার আতঙ্কে নগরবাসী। গ্রীস্মকালীন অল্প বৃষ্টিতেও এমন রূপ এখন ভীতি চড়াচ্ছে নগরজুড়ে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে গেল ১৪ বছরে ১ হাজার ৪৮৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে সুফল পায়নি নগরবাসী। এর জন্য সিসিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তারা। তাদের দাবি, সিসিকের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় সরকারি টাকায় অপচয় আর লোটপাট হয়েছে কিন্তু জলাবদ্ধতার নিরসন হয়নি। এত টাকা খরচের পরও নগরের জলাবদ্ধতামুক্ত না হওয়ায় এসব প্রকল্পের অনিয়ম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নগরবিদরা বলছেন, যেকোনো নগরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পিছনে থাকে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আর পরিকল্পনা হতে হবে সেই নগরের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, নগর জীবন ও সংস্কৃতি নির্ভর। আর নগর পরিকল্পনাবিদরা সেই কাজটিই করে থাকেন। তাদের সুপারিশ কিংবা পরামর্শ গ্রহণ করা হলে নগরীর জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে সমাধান করা সম্ভব হতো। তবে সিসিকের প্রতি ক্ষোভ নাগরিকদের। তাদের বক্তব্য, কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে সিসিক কখনো সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করে না।
জলাবদ্ধতা নিরসনে যত প্রকল্প
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গেল ১৪ বছরে প্রকল্প হয়েছে ৪ টি। এর মধ্যে তিন প্রকল্পে সরকার বরাদ্ধ দেয় ১১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর ছড়াগুলো উদ্ধার কার্যক্রম চালায় সিটি করপোরেশন। এরপর ২০১৩ সালে একই লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয় ২০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। এরপর ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ২৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প। এর মধ্যে এই ৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে অভিজ্ঞরা বলছেন, সিসিকের নির্ধারিত অ্যাকশন প্ল্যান না থাকায় প্রকল্পগুলো থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পরেনি। যার ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে বরং কমেনি।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বেরে জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। প্রশ্ন উঠেছে গেল একযুগ ধরে এত প্রকল্প, এত বরাদ্ধ স্বত্বেও কি পেল নগরবাসী? তারা না জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে, না বন্যার গ্রাস থেকে মুক্তির সম্ভাবনা দেখতে পেরেছে। সব মিলিয়ে আসন্ন বর্ষার আগেই শঙ্কায় সিলেট নগরবাসী।
নগরীতে যতো নদী, খাল ও ছড়া
বাপা’র দেওয়া তথ্য মতে, সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা ও কুশী নদী। তাছাড়া গাভীয়ার খাল (নবাব রোড, কানিশাইল), জৈন্তার খাল ( ২৫ নং ওয়ার্ড বারখলা) রত্নারখাল ( ২৫ নং ওয়ার্ড বারখলা) ও বসুর খাল (কুয়ারপাড়) নিয়ে মোট ৪টি খাল রয়েছে । আর ছড়া রয়েছে প্রায় ২৫টি। ছড়াগুলো হলো- বারুতখানা ছড়া, জল্লার ছড়া, মির্জাজাঙ্গাল ছড়া, কেওয়া ছড়া, বৈঠা ছড়া, মালনী ছড়া (চৌকিদেখি-হাউজিং এস্টেত-মিরেরময়দান-সাগরদিঘি-বাঘবাড়ি),মংলী ছড়া (রিকাবীবাজার),মঙ্গলী ছড়া (লোহারপাড়া-দরগাগেইট),মোগলী ছড়া,মুগনী ছড়া (কাজিরবাজার), গোয়ালী ছড়া (তেররতন-উপশহর-ছড়ারপাড়), কালীবাড়ী ছড়া, হলদি ছড়া (শাপলাবাগ, ব্রাম্মণপাড়া, সাদীপুর), যুগনী ছড়া, ধোপা ছড়া, বুবি ছড়া,বাবু ছড়া (দক্ষিণ সুরমা) বলরাম ছড়া (জিন্দাবাজার-জামতলা-তালতলা)।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২৫টি ছড়া। তবে দখল-দূষণে এখন অনেক স্থানে ছড়ার অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে। নগরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৩টি বড় ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরে এসব ছড়ার দুই পাশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন অবৈধ দখলদাররা। এই ছড়াগুলো উদ্ধারে এই ৩টি প্রকল্পে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন । সর্বশেষ ২০১৬ সালে ছড়া-খাল দখলমুক্ত করতে ২৩৬.৪০ কোটি টাকার বৃহৎ একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে এসব বৃহৎ প্রকল্পের পরও ছড়া দখলমুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
যে কারণে জলাবদ্ধতা
প্রথমত, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ছড়া-খাল দখলদারদের একটি তালিকা করা হয় ২০১৬ সালে। এতে ২৬৮ জনকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দখলদারদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। এ ছাড়াও কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ছড়া-খাল দখল করে এরা গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। অনেকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন ছড়ার গতি। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের পথ। এতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও এই সময়ে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে আরও কয়েকটি ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। তবে এত প্রকল্প, এত অর্থব্যয় সত্বেও প্রভাবশালী দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারায় এসব প্রকল্পে তেমন সাফল্য আসেনি। মুক্তি মেলেনি জলাবদ্ধতা থেকে।
দ্বিতীয়ত, পানির অবাধ প্রবাহ রক্ষায় ছড়া-খালকে অবৈধ দখলবাজদের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দুই পাশে গার্ডওয়াল নির্মাণ করে পাহাড় থেকে নেমে আসা ‘ছড়া’ নামের পানির এই প্রবাহকে ড্রেনে রূপান্তরিত বন্ধ করতে হবে। এতে ছড়াগুলো তাদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারায়। ঢাকা ব্যতীত বাংলাদেশের আর কোনো বিভাগীয় শহরে সিলেটের মতো এতগুলো প্রাকৃতিক ছড়া বা খাল নেই। প্রতিটি ছড়ার ছিল নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র। বিভিন্ন পণ্য প্রাণী ও জলজ প্রাণের উপস্থিতি ছিল এই ছড়াগুলোতে। গার্ডওয়ালের জন্য ছড়ার এই বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়াও পয়: নিষ্কাশনের পানি ও নাগরিক বর্জ্য ছড়া বা খালে নিক্ষেপ অব্যাহত আছে। এর কারণ যে পরিমাণ অর্থ দখল-দূষণ থেকে বাঁচানোর জন্য ছড়ার পেছনে ব্যয় হয়েছে এর সামান্য অংশ দূষণবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়নি। দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে একটি বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখাও প্রাসঙ্গিক।
যেভাবে করতে হবে সমাধান
ভূ-প্রকৃতিগত বা অবস্থানগত কারণে যেমন সব নগর সমান নয়, একইভাবে সব নগরের জীবনধারণ প্রণালীও এক নয়। যেমন সিলেট অঞ্চল অনেকটা সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। এর আশেপাশে প্রচুর টিলা এবং চা বাগান রয়েছে। ফলে বর্ষাকালে নেমে আসা ঢল সেগুলো শহরের বিভিন্ন ছড়া, নালা ও খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই পানির অবাধ প্রবাহ রক্ষায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা এমন হতে হবে যেন সবটুকু পানি গিয়ে মিলিত হয় নদীর সাথে। কিন্তু সিলেটের ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না। এর ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার কবলে পরে সিলেট। একই সাথে ড্রেনগুলোতে ঢাকনা না থাকায় কিছু সংখ্যক মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য খোলা ড্রেনগুলোকে ব্যবহার করেন। সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর কারণে নগরের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে সুরমা নদী খনন করতে হবে। তা না হলে কেবল ছড়া উদ্ধার করে কোনো সুফল মিলবে না।
এ ছাড়াও ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য যত সম্ভব নগরীতে বাস্কেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাইকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে বাড়াতে হবে সচেতনতা। তদারকি টিম গঠন করে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে ধর্ম প্রচারকদের ব্যবহার করে নোঙড়া আবর্জনার কুফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানসহ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
যা বলছে সিসিক
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, নগরীতে আগের মতো আর জলাবদ্ধতা হয় না। অধিক বৃষ্টিতে নগরীর কিছু এলাকায় পানি জমলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা নেমে যায়।
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আমরা দখলদারদের উচ্ছেদ করার পর ফের ছড়া দখল হয়ে যায়। এ ছাড়াও ময়লা-আবর্জনা ফেলেও ছড়ার পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এটা কোনোভাবেই সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়।
অভিজ্ঞজনদের মতামত
সিলেট নগরের উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এর কারণে নগরের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে সুরমা নদী খনন করতে হবে। তা না হলে কেবল ছড়া উদ্ধার করে কোন সুফল মিলবে না।
শিক্ষাবিদ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, নাগরিক সেবা সুনিশ্চিত করার জন্য সুপরিকল্পিত নগরায়নের পূর্বশর্ত। এক্ষেত্রে জরুরি, সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত অংশগ্রহণ ও সময়ের প্রয়োজনে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসা। গুরুত্ব বিবেচনায় সময়ানুগ প্রকল্প গ্রহণ এবং বরাদ্দ সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন।
তিনি আরও বলেন, নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য নদী শাসনের পাশাপাশি ড্রেনেজ সিস্টেমের আধুনিকিকরণ। সর্বোপরি বিশেষজ্ঞ নগরবিদদের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহারে নাগরিক জীবনে সেবা নিশ্চিত করা যাবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেট নগরীর ছড়া বা খাল দখলদারদের থেকে উদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে সরকারের কাছ থেকে বিরাট অংকের অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। কিন্তু দখলদারদের থেকে এখনও মুক্ত হয়নি অনেক ছড়া। উপরন্তু ছড়া রক্ষা করতে যেয়ে প্রাকৃতিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দুই পাশে গার্ডওয়াল নির্মাণ করে পাহাড় থেকে নেমে আসা 'ছড়া' নামের পানির এই প্রবাহকে ড্রেনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এর ফলে ছড়াগুলো তাদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই অপকর্মের জন্য এককভাবে সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা ঠিক হবে না। এর দায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপরেই বর্তায়।
বাপার এই নেতা বলেন, যে পরিমাণ সরকারি অর্থ দখল-দূষণ থেকে বাঁচানোর জন্য ছড়ার পেছনে ব্যয় হয়েছে এর সামান্য অংশ দূষণবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়নি। উচিত ছিল দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে একটি বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখা। তা করা হয়নি। তাই সামগ্রিকভাবে বলতে হবে, সিলেট নগরীর ছড়া বা খাল দখল ও দূষণমুক্ত করতে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই ব্যয় রয়েছে দূরদর্শিতার অভাব। সেই ব্যয় কোনোভাবেই প্রকৃতি বান্ধব নয়।
এসআইএইচ