নষ্ট প্রেমের দহন
নাজনীনের অস্থিরতা বেড়েই চলছে। কোনভাবেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা।একটা অশুভ চিন্তা তার মনের কোনায় বারবার হানা দিয়ে যায়।মনের সাথে যুদ্ধ করে সে। এ কি করে সম্ভব? এমনটি সে ভাবতেই পারে না! তাহলে আকাশের মোবাইল ফোনটা বন্ধ কেন?এরই মাঝে আকাশের বন্ধু, অফিসের বস,যাদের সাথে ঘনিষ্টতা রয়েছে আকাশের, সকলকেই ফোন করেছে নাজনীন। কেউ তার হদিস বলতে পারছেনা ওর কাছের বন্ধুদের মধ্যে আবির, দুর্জয় ওরাও বর্তমান অবস্থান জানে না। মোবাইল ফোন বন্ধ হওয়ার আগের বিকেলে নাকি দুর্জয়ের সাথে ছিল,রাতে ঘুমায় বন্ধুর বাসায়। শেষ রাতের দিকে উঠেই কাউকে না জানিয়ে চলে যায় আকাশ। তারপর থেকে ফোন বন্ধ। অল্প কিছুক্ষণ হলো নাজনীন মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরেছে। এই সময়েই ফোনটা আসে। কথাটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে থাকে অনেকক্ষণ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এ যে হতেই পারে না! কিন্তু রোদেলার স্বামী স্পষ্ট করেই বলে দিল। আপু তোমার স্বামী আমার বউকে নিয়ে চলে গেছে।
গত তিন দিন থেকেই আকাশের মোবাইল ফোন বন্ধ। নাজনীন প্রথমেই ফোন করেছিল আকাশের অফিসে। তার বস জানিয়ে দিল সে গত বেশ ক'দিন অফিসে আসছে না। অফিস থেকে উল্টো জানতে চায়, আকাশের কি হয়েছে? অফিসকে না জানিয়ে , ছুটি ছাড়াই সে সপ্তাহ খানেক অফিসে যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে নাজনীন কিছুই ভাবতে পারে না। কেন এমন হবে? সে ত কোন ভাবেই অপূর্ণ রাখেনি আকাশকে। তাদের সংসারে ভালবাসার অভাব ছিলনা কখনোই। চাঁদের আলোর মতো দু'টি কন্যা নাজনীনে'র কোল আলো করে আসে। ভালবাসার চির বন্ধনকে অটুট রাখতে। সাজানো সুখের সংসার কালবৈশাখী ঝড়ে সব এলোমেলো করে দেয়।নাজনীনের দুগাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ে। হাজার পাওয়ারের বাতি ঢিপঢিপ করে জ্বলতে থাকে দুচোখের তারায়। টর্নেডোর আওয়াজ শুনে হাজার মাইল জুড়ে। ছোট মেয়েটি কোলে এসে জড়িয়ে ধরে। কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছ কেন? তুমাকে কে বকেছে মা? আমাকে বলো, বাবা বাড়ী এলে, যে তোমাকে বকেছে তাকে মারতে বলবো। মৃত্তিকার আদো আদো বুলে এই কথাগুলি আরো বেশি আঘাত করে নাজনীনকে।
সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। এমন সময় গেটে কলিং বেল বেজে উঠে। উঠে গিয়ে গেট খুলে দেখে শাওলি। স্কুল ড্রেস পরা মেয়েকে আজ খুব আহলাদি মনে হয়। কাঁধে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে, হেলতে দুলতে উঠে যায় দু'তলায়। শাওলি রুমে ঢুকেই স্কুল ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দেয় খাটের উপর। ড্রয়িং রুমের সোফায় একটু বসার পর বাথ রুমে যায় ফ্রেস হতে। বেরিয়ে এসে হাত-মুখ মুছতে মুছতে বলে: আম্মু ভাত দাও, প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। নাজনীন এবার মুখ তুলে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে: রান্না করিনি মা। ফ্রিজে খাবার আছে এখন বের করে খেয়ে নাও। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় শাওলি। একি চেহারা মায়ের? আলুথালু বেশ,এলো চুল,চোক দুটি লাল জবা ফুলের মতো। দুগাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে অনর্গল। শাওলি অবাক হয়ে এগিয়ে যায় মায়ের কাছে।মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, কি হয়েছে মা? গভীর কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আছে নাজনীনের। অস্পষ্ট স্বরে বলে তোমাদের কপাল পুড়েছে মা। তুমার বাবা তোমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমার পৃথিবী জুড়ে গভীর অমানিশার অন্ধকার।
সেদিনের সেই সন্ধায় আকাশ নিজেকে আবিষ্কার করে ভিন্ন মাত্রায়! সেকি কখনো এইভাবে কল্পনা করেছে রোদেলাকে? নাজনীনের দুর সম্পর্কের আত্মীয় রোদেলা। ছোট বেলা থেকেই রোদেলা মানুষ হয়েছে তাদের কাছে।আপন ছোট বোনের মতোই এই সংসারে বেড়ে উঠেছে রোদেলা। আকাশ-রোদেলা, দু'জনই মানসিকভাবে কখনো ভাবেনিঃ ভিন্ন কিছু। রোদেলার পড়ালেখা শেষ হতেই আকাশ একটি সুপাত্রের সন্ধান করতে থাকে। একটি ভাল ছেলে পেয়ে যায়। বেশ ঘটা করেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। রোদেলার বিয়েতে প্রচুর খরচ করে আকাশ। সোনা,গয়না, ফার্নিচার থেকে শুরু করে বেশ কয়েক হাজার মানুষকে দাওয়াত করেন। বেস আনন্দ ঘণ পরিবেশে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সমস্যা তৈরি হয় রোদেলাকে শশুর বাড়ী তুলে নেওয়ার পরে। স্ত্রী, সন্তান,মা, ভাই-বোন সব থাকার পরও আকাশের সবকিছুই শূন্য মনে হচ্ছিল! আকাশ ভাবে, কেন এমন হবে? তাদের মাঝেতো কোনরূপ অপবিত্র সম্পর্ক ছিল না। একসাথে থাকা-খাওয়া,হাসি-আনন্দ, জীবনের সবকিছুই ভাগ করা ছিল। কিন্তু তারা কেউ ভিন্ন চিন্তা করেনি পরস্পরকে ঘিরে। কিন্তু জীবন যখনি আলাদা, তখন কেন এমনি হচ্ছে? রোদেলা যাওয়ার পর থেকে, আকাশের জীবনে শূন্য অনুভুতি নেমে আসে। সংসার, কাজ, বন্ধু,আড্ডা,রাজনীতি সবকিছুই মনে হয়ে অর্থহীন।
সেদিন অফিসে যাওয়ার পথে নাজনীন আকাশকে বলে দেয়, রোদেলা শশুর বাড়ী গেল একমাস পার হয়ে গেল।কোন খবর নেই! ফোন করলেও অল্প কথা বলে। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে, একটু খোঁজ নিয়ে এসো। ওদের বলে এসো আগামী সোমবার আসতে। ১০ ফেব্রুয়ারি শাওলির জন্মদিন। তোমার মনে আছেতো মেয়ের জন্মদিনের কথা? আকাশ চোখ তুলে বলে, মেয়ে আমার আর মনে করিয়ে দিবে তুমি! তারপর বলে ঠিক আছে আমি অফিস থেকে ফেরার পথে ওদের বলে আসব। আকাশ একটু আগেই অফিস থেকে বের হয়ে যায়। লোকাল বাসে করেই চলে যায় রোদেলার শশুর বাড়ী। দরজায় কলিংবেল বাজাতেই, রোদেলা দরজা খুলে দেয়। আকাশকে দেখে রোদেলা বলে ভাইয়া! তুমি? আমার কথা মনে পড়লো তোমার? রোদেলার সাথে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে আকাশ। রেদেলাকে দেখে অবাক হয় আকাশ! একি চেহারা হয়েছে মেয়েটার? এই ক'দিনেই চোখ,মুখ বসে গেছে। গায়ের রং কালো হয়ে গেছে, শুকিয়ে কঙ্কাল। সামনে বসা রোদেলাকে প্রশ্ন করে আকাশ, একি অবস্থা তোমার? রোদেলা উত্তর দেয়ার আগেই ওর শাশুড়ী ঢুকে যায়। সেই বলে: কেমন আছ বাবা? রোদেলাকে নিয়ে আমরা খুব বিপদে: আকাশ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে কেন, কি হয়েছে? দেখ বাবা: তোমাদের বাড়ী থেকে আসার পর থেকেই সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। কিছু খেতে চায় না,কারো সাথে তেমন কথাও বলে না, রাতে নাকি ঘুমায় না! এখন কি করবো বল তো? আকাশ রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে : এসব কি রোদেলা! কি হয়েছে তোমার? মাথা নিচু করে উত্তর দেয় রোদেলা, আমার কিছুই ভাল লাগেনা ভাইয়া।
এসময় চাই, নাস্তা নিয়ে আসে কাজের বোয়া। রোদেলার শাশুড়ী কে আকাশ বলে, রোদেলাকে তার আপু আগামী সোমবার যেতে বলেছে, শাউলির জন্মদিন। রোদেলা বলে, আমাকে আজকে নিয়ে যাও। আমার বাড়ী যেতে খুব ইচ্ছে করছে। রোদেলাকে সমর্থন করে তার শাশুড়ী বলে তাই করো বাবা। ওকে নিয়ে গিয়ে দেখ, জায়গাবদল হলে হয়ত-তার শারিরীক, মানসিক পরিবর্তন আসতে পারে।
আধ ঘন্টার মধ্যেই রোদেলা প্রস্তুত হয়ে আসে। বাসার গেট পার হতেই ওদের বুকের পাথর নেমে যায়। আকাশের মনে হয়, কি যেন ফিরে পেল সে। অল্প সময়েই পাল্টে যায় রোদেলা। কথা বলতে শুরু করে অনর্গল। সিএনজি ধরেই তারা বাসায় ফিরে। রাতেই রোদেলাকে পেয়ে নাজনীন,শাওলির আনন্দ যেন আর ধরে না। একমাস পরে এই বাড়ীতে যেন প্রাণ ফিরে আসে।
এই কটা দিন বেশ আনন্দেই কেটে যায়। শাউলির জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হলো দুই দিন। আজ রোদেলার বর এসেছে তাকে নিয়ে যেতে। আবারো অন্ধকার ঘণিয়ে আসে দু'জনের। এই ক'দিনে নতুন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। সে দি ন শাওলি স্কুলে, মৃত্তিকাকে নিয়ে কিন্ডার গার্ডেনে গিয়েছে নাজনীন। নিরিবিলি বাসায় রোদেলা-আকাশ। চা নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে রোদেলা। আকাশের সামনে চা দিয়ে পাশেই বসে। মাথা নিচু করে কাচুমাচু করে বলে, ভাইয়া তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। রোদেলার কথায় বাধ ভেঙ্গে যায় আকাশের। কিছুক্ষণ রোদেলার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর কাছে টেনে নেয়। এবার আকাশের বুকে গড়িয়ে পরে রোদেলা।
আকাশ বলে, তোকে ছাড়া আমার পৃথিবী যে অন্ধকার! তারপর বাধভাঙ্গা জোয়ার, যা কল্পনা করা যায় না, তাই ঘটে যায়। ঘন্টা খানেক পরে ওরা ফিরে আসে আপন সত্তায়। কিন্তু ততক্ষণে ওরা অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। পাল্টে যায় সম্পর্কের গন্ডি। এই কদিনে বেশ ক'বার একাকিত্বে সময় কাটিয়েছে ওরা দুইজন। তারা যেন হাজার বছরের চেনা। প্রেমিক প্রেমিকা!
আজ স্বামীর সাথে চলে যায় রোদেলা। আবার শুরু হয় অস্থিরতা।ওদিকে রোদেলা, এদিক আকাশ একই অবস্থা।রাতে মোবাইলে কথা হয়ে ঘন্টা ধরে। বাড়তে থাকে অস্থিরতা। রোদেলা-আকাশ ছাড়া কেউ আঁচ করতে পারে না। দুই জীবন দুই দিকে গুমরে গুমরে মরে। কাউকে বলতেও পারে না। সমাজ,সংসার, সামাজিক অবস্থান তাদের বুকে পাথর চাপা দেয়। সময়ের চাকা ঘুরে। বাড়তে থাকে অস্থিরতা, কষ্ট। বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব মনে হয় ওদের কাছে। তখনই ঘটে চুড়ান্ত দুর্ঘটনা।
প্রতি রাত আর দিনের আলোয় নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করে, অশুভ প্রেমের পরিণতি। জীবনের গতি অনিশ্চয়তায় মুঁছে যেতে থাকে। আগামীর নতুন পৃথিবী ওদের ডাক দিয়ে যায়। ঠিকানা বিহীন এক যাত্রা পথের মাত্রা নির্দেশ করে।
মোবাইলে কথা হয়েছিল রাতেই। খুব ভোরেই পালিয়ে যায় ওরা। চেনা পৃথিবীর গন্ডি ছেড়ে হারিয়ে যায় ওরা। সকল বাধা পিছনে ফেলে, ছুটে চলে অজানার ঠিকানায়। যেখানে কেউ তাদের চিনবে না কোন প্রশ্ন করবে না। বন্ধনহীন জীবনে নতুন বাঁধনে জড়িয়ে।
ডিএসএস/