প্রিয় প্রতারণা
‘আ্যই রিশান, ঘুড়ির সুতোটি ঠিকভাবে ধরো, উড়ে যাবে তো!’ নাদিয়ার কথায় যেনো হুঁশ ফিরে পায় রিশান। সুতোর প্রান্তটি শক্ত করে হাতে নেয়, যেনো সুতোটি ছুটে গেলে হারিয়ে যাবে তাদের স্বপ্নটিও।
সময়টি অগ্নিঝরা একাত্তর সালের শুরুর দিকের কথা। রিশান ও নাদিয়া- স্নাতকোত্তর পড়ুয়া রিশান ও স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ুয়া নাদিয়া। তারা আকাশে ঐ ঘুড়িটি ওড়ানোর মতই স্বপ্ন ওড়ায়- সে স্বপ্ন সারাজীবন ধরে একে অপরের পাশে চলার স্বপ্ন, বিশ্বস্ততার সারথী হিসেবে একে অপরের হাতটি ধরে রাখার স্বপ্ন। সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, সীমাবদ্ধতার গন্ডি, অনিশ্চয়তার দোলাচলে থাকা আগামী এবং দেশের বিরাজমান সংকটময় পরিস্থিতি কোনো কিছুই তাদের অনিন্দ্যসুন্দর স্বপ্ন দেখায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না।
একাত্তরের মার্চের শেষ সপ্তাহ- বাংলার মাটিতে প্রবেশ করলো পাকিস্তানি সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত দখলদার বাহিনী। শুরু হলো তাদের অত্যাচারের আগুনে তৈরি হওয়া লেলিহান শিখার দাবদাহ। রাজধানী ঢাকার অন্যান্য এলাকার মত রিশান ও নাদিয়ার এলাকাতেও বিরাজ করছিলো চাপা উৎকন্ঠা ও উত্তেজনা। রিশানের বাবা স্থানীয় কলেজের দর্শন বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. আজগর আলী। তিনি নিজে যেমন দেশপ্রেমে বলীয়ান তেমনি তার নিজ পুত্র রিশানকেও মানুষ করেছেন দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণটি তিনি তার বাবার থেকে উপহার পাওয়া টেপরেকর্ডারে বারবার নিজে শুনেন এবং তার পুত্র রিশানকে শোনান। তার মনে হয় স্বাধীনতা নামক সোনালী স্বপ্নটির যে বীজ বাঙালি বপন করে চলছিলো, বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় কন্ঠে যেনো সেই বীজ পরিণত বৃক্ষের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। মুদ্রার ঠিক বিপরীত চিত্রটিই যেনো নাদিয়াদের বাড়িতে। নাদিয়ার বাবা জনাব করীম খান পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি যেনো তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার আস্থা ও বিশ্বাসের একজন প্রতিমূর্তিসরুপ। তার কাছে বাঙালির মুক্তির স্বপ্নপূরণের মুক্তিসংগ্রাম এক নিতান্ত অভ্যন্তরীন কলহ বা গন্ডগোল হিসেবেই প্রতীয়মান হয় এবং তার বিশ্বাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তৎকালীন সরকার দ্রুতই এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে জনজীবন স্বাভাবিক করবে। কিছুদিন এভাবেই গড়িয়ে যায়….
হঠাৎ এক সন্ধ্যায় নাদিয়াকে রিশানের জরুরি তলব।
রিশান নাদিয়ার হাত দুটি ধরে বললো, ‘ধরো আমি যদি চলে যাই দূরে তোমার দৃষ্টির অন্তরালে, তবে তুমি কি আমায় রাখবে মনে?’ নাদিয়া বিস্ময় চোখে ধারণ করে বলে, ‘এই মুখ, এই চোখ জম্ম-জম্মান্তরে শুধুই আমার, আমি তোমাকে আমার করে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করতে পারবো। কিন্তু আজ হঠাৎ করে তুমি এ কথা কেনো বলছো?’ রিশান একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তুমি তো জানো দেশের এখন কি অবস্থা! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর তাদের অত্যাচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশমাতৃকার মুক্তির পানে গঠিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আচ্ছা নাদিয়া, তুমি কি আমাদের পাশের বাসার শিপন ভাইকে চিনতে?’ নাদিয়া উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, চিনতাম তো, শুনেছি সে নাকি ভারতে অনেকদিন ছিলো।‘ রিশান বললো, ‘হ্যাঁ, সে ভারতে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষে গতকাল রাতেই ফিরেছে। সে এখন আমাদের সবাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করতে চায়। আমার বাবার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সম্মতি আছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।
‘ নাদিয়া মুচকি হেসে বললো, ‘কেনো আমাকে হারানোর তোমার এত ভয়! তুমি অবশ্যই যাবে এই মা, মাটি ও মানুষকে রক্ষার জন্য। আমি চাই আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী আমরা গড়ে তুলবো স্বাধীন বাংলার মাটিতে।‘ অশ্রুসজল দৃষ্টিতে রিশান বিদায় নিলো নাদিয়ার নিকট থেকে। রিশান ছুটে চললো এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উম্মোচন করতে।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বহর ঐ দিকে অবস্থান নিয়েছে নাদিয়াদের বাড়ির পাশে। একদিন ঐ বহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জামশেদ এলো নাদিয়াদের বাড়িতে তার বাবা করীম খানের সাথে দেখা করতে। হঠাৎ নাদিয়া ক্যাপ্টেনের সামনে পড়ে যায় এবং নাদিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ইতোমধ্যেই একবার বিয়ে করা ক্যাপ্টেন জামশেদ নাদিয়ার বাবার কাছে পেড়ে বসে নাদিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব। বাবা যখন নাদিয়াকে প্রস্তাবের কথা বলে তখন নাদিয়া ঘৃণাভরে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। নাদিয়ার বাবা তখন ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেন, ‘আমি তোমার ও রিশানের কথা জানি। কিন্তু আমি তা কখনোই মেনে নেবো না। রিশান একজন বিদ্রোহী। তুমি যদি এ বিয়ের প্রস্তাব মেনে না নাও তবে আমি রিশানের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংবাদ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিবো এবং বুঝতেই পারছো তারা রিশানকে খুঁজে বের করে সপরিবারে হত্যা করবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার-তুমি কী চাও? রিশানের জীবন নাকি তোমার গোয়ার্তুমি?’ নাদিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে জানে যদি এখন বাবাকে না বলে দেয় তবে রিশানের জীবনই শুধু বিপন্ন হবে না, তার সাথে পুরো মুক্তিবাহিনীর বৃত্তান্ত চলে যাবে পাকিস্তানি বাহিনীর করায়ত্তে, যার ফলে স্বাধীনতার দুর্বার স্বপ্নটি হয়তো থমকেই যাবে। মনের সাথে সকল যুদ্ধ সম্পন্ন করে এক আকাশ আবেগকে পাশে ঠেলে নাদিয়া বাবার প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। ক্যাপ্টেন জামশেদ নাদিয়াকে বিয়ে করে সেদিনই তাকে নিয়ে পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে চলে আসে।
গভীর রাত, সুনসান নীরবতা, সেই নীরবতাকে ভেঙ্গে ক্যাপ্টেন জামশেদ অট্টহাসি নিয়ে এগিয়ে আসে নাদিয়ার দিকে। কিন্তু তার সেই অট্টহাসি মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। নাদিয়া তার পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলো ধারালো এক ছুরি। ক্যাপ্টেন জামশেদ তার সামনে এলে নিজের দেহের সমস্তশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাপ্টেনের উপর, তার বুকে বিঁধে দেয় ধারালো ছুরি। মুহুর্তেই ক্যাপ্টেনের দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ক্যাপ্টেনের আর্তচিৎকারে পাশের কক্ষ থেকে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে অস্ত্রধারী দুই জন সেনা। তারা চোখের নিমিষেই গুলি বর্ষণ করে নাদিয়ার দিকে। চোখের পলকেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা ও রিশানের মায়াময় মুখটি কল্পনা করে নাদিয়ার অসাড় দেহটি মাটি স্পর্শ করে।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষ হয়, জয় বাংলার মুহুর্মুহু ধ্বনিতে মেতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশের পতাকা মাথায় তুলে ফিরে আসে নিজ ভূমে। সবার সাথেই বীরবেশে ফিরে আসে রিশান এবং সাথে ফিরে স্বাধীন দেশের মাটিতে নাদিয়াকে নিয়ে ঘর বাঁধার সেই স্বপ্ন। কিন্তু রিশানের মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগে না, নাদিয়াদের বাড়ি থেকে রিশানকে জানানো হয় যুদ্ধকালীন নাদিয়ার নিজ ইচ্ছাতেই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন জামশেদের বিয়ে হয় এবং তারা এখান থেকে চলে যায়।
রিশানের পুরো পৃথিবীটি থমকে যায় স্বপনভঙ্গের বেদনায়। বাকি জীবনটি রিশানের চিন্তা ও মননে নাদিয়ার রুপটি আঁকা হয়ে থাকে এক ছলনাময়ী, প্রতারক ও স্বার্থপরতার এক নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত হিসেবে।
আর নাদিয়ার কথা ভাবছেন- সে তো হেরে গিয়েও জিতে যায়। তার কালজয়ী আত্মত্যাগ রিশান হয়তো জানে না বা জানবেও না কোন দিন, কিন্তু নিজ ভালোবাসার মানুষ ও দেশমাতৃকাকে বাঁচানোর জন্য তার আত্মবিসর্জন পাঠক মনে সব সময়ের জন্যই দোলা দিবে……….
ডিএসএস/