পৌষ সংক্রান্তি এবং আমার মা
দু’দিন বাদেই পৌষ সংক্রান্তি। এবার সংক্রান্তিতে মায়ের সান্নিধ্য কিছুতেই মিস করতে চাই না। প্রায় দুসপ্তাহ হবে, চিকিৎসা শেষে মা চলে গেছেন বাড়িতে। আজকাল মায়ের শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছে না। সংক্রান্তি আসতেই আজ মায়ের কথা যেন আরেকটু বেশি করে মনে পড়ছে আমার।
মনে পড়ে শৈশবে খুব ডানপিটে ছিলাম বলে আমার জন্য মাকে কতো বকুনি সহ্য করতে হতো। আমার বাবা ছিলেন ভয়ানক মেজাজি মানুষ। বাবার সেই অগ্নিরূপ যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তারাই সেই স্বরূপের বিবরণ খুব ভালোভাবেই দিতে পারবেন। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে আমার অবস্থান ছিল ৫ম। কিন্তু দূরন্তপনায় সবাইকে টপকিয়ে আমি ছিলাম বরাবরই প্রথম। আজ এ সব কথা ভাবতে ভাবতে আমার সারা শরীরটা কেমন যেন হিম হয়ে যাচ্ছে। দু'চোখে ঠলমল করছে অশ্রুবিন্দু। ভেজা ঝাপসা চোখ নিয়েই আবারো লেখাটায় মন দিতে থাকি।
বাড়ির বাইরে কাটানো সারাদিনের অভিযোগের হিসাব যখন এক এক করে বাবার হালখাতায় জমা হতো, বাবাও সেই হিসেবের খরচটি দিন শেষে ষোলআনাই আমার শরীরে কষিয়ে দিতেন। শরীরের সেই ক্ষত যন্ত্রণার স্থায়িত্বও থাকত অনেকদিন। আর মা কেবল দূর থেকে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতেন। বাবার কাছে আসার সাহস ছিল না বলে, বাবা চলে যাওয়ার পর এক দৌড়ে কাছে এসে আমাকে ঝাপটে ধরে মা কতো সময় যে বুকে জড়িয়ে রাখতেন, তা আজ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ময়ের কান্নায় আমার কান্নার বেগ আরও বৃদ্ধি পেত। মা কোনো দিনই আমি অথবা আমার ভাইদের গালমন্দ করতেন না। তবে রাগ করে প্রায়ই বলতেন, ‘রে হতভাগা— তোদের বাবার আঘাতের পর যদি শরীরে এতোটুকু জায়গা বাকি থাকত, তাহলে সে অংশে আমিও দাগ বসিয়ে দিতাম’।
সংক্রান্তি উপলক্ষে কালই বাড়ি যাব। আর এ কথাটা মনে হতেই চোখের সামনে ফেলে আসা সংক্রান্তিগুলো আয়নার মতো ভাসতে লাগল। সারারাত জেগে মা যখন পিঠে আয়োজনে ব্যস্ত, আমি তখন বিছানায় থেকে প্রহর গুনতাম, কখন গরম পিঠা তৈরি হবে। মা অবশ্য জানতেন, তার দুষ্টু ছেলে পিঠা না খাওয়া অবধি ঘুমুবে না কিছুতেই। আমার সব ভাইয়েরা খাবারের বেলায় আমার মতো খুব পটু না থাকলেও মায়ের হাতের যাদুর পিঠাতে লোভ ছিল সবারই। মায়ের হাতের পুলি পিঠার স্বাদ বাকি জীবনেও ভুলা সম্ভব নয়। তবে কেউ পিঠা চুরি করত না। মা আর বোন মিলে যখন উনুন থেকে পিঠা নামাতেন, মা তো দিদিভাইকে বলেই ফেলতেন ‘যা আগে তোর রাক্ষস ভাইটাকে দিয়ে আয়’। দিদিভাইটাও জানত গোটা বাড়ির সবাই জেগে থাকলেও তার এই ভাইটি পিঠা খাওয়ার আগে কিছুতেই ঘুমুবে না। অবশ্য, এর একটি কারণও ছিল। মা জানতেন, তার এই রাক্ষস ছেলেটার চাহিদা না মেটালে পরদিন ঘুম থেকে উঠে পিঠের হাড়িঁ সব গুলোই শূন্য থাকবে। মা তাই প্রায়ই খাবার-দাবার কিছু হলে সবার আগে আমার কাছে নিয়ে আসতেন আর বলতেন ‘খা পোড়ামুখা’। কারণ, আমার চাহিদা শেষ হলে মা একটু চিন্তামুক্ত থাকতেন এই ভেবে যে— অন্তত পিঠার হাড়ি আর যাই হোক এখন আর শূন্য থাকবে না।
মা আমাকে বরাবরই একটু বেশি আদর করতেন। আমি জানি না, হয়তোবা দুষ্টু ছেলেরা মায়ের ভালোবাসা একটু বেশি করেই পেয়ে থাকে। এখন মা আর শারীরিক ভাবে কোনো কিছুই করতে পারেন না। আর এই ‘হতভাগা’ 'পোড়ামুখা'কে নিজ হাতে পিঠা না খাওয়াতে পারায় মায়ের সে কি সকরুণ চাহনি তা আমি তিলে তিলে অনুভব করি।
মা যখন চিকিৎসার জন্য বাসায় ছিলেন প্রায়ই আমার স্ত্রীকে কী খাবার আমি ভালোবাসি এবং কী দিয়ে সেটা করতে হবে তার নির্দেশনা দিতেন। মা তোমাকে কীভাবে বলি, মা-ছেলে তো নাড়ি ছেড়া সম্পর্ক। তুমি বিহীন আমার প্রতিটা খাবারে আজ তোমার স্বাদ অনুপস্থিত গো মা।
আমার বাবাও খাবারের প্রতি ছিলেন প্রচণ্ড দুর্বল। তাই আমাদের পরিবারে বাধ্যতামূলক মশুরির ডালের সঙ্গে অন্তত আরও ৩/৪ আইটেম থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার পর বিয়ে পরবর্তী পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আজ আমার স্ত্রী কোনোরকমে দু’আইটেম রান্না করেই সারা গোষ্ঠী উদ্ধার করে।
আমার ছোট ভাইটিও আজ অনেক দূরে। শৈশবে দু‘ভাইয়ে মায়ের ভালোবাসা নিয়ে কতো ঝগড়া করেছি। আজ সে প্যারিস প্রবাসী। ভাই তুই যতো দূরেই থাক ভালো থাকিস। আমি আছি আজ মায়ের কাছে। মা কিন্তু আজ তোর কথাই বেশি মনে করবে রে পাগল! আমিও তোকে খুব মিস করিরে ভাই।
মাগো’ আমি আসছি। কতোদিন তোমার হাতে কোমর পাতা দিয়ে শুটকি বড়া নাড়িতে জুটেনি। তবুও আমি আসছি মা। শুধু তোমায় দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আরেকবার আমি সেই শৈশবে ফিরে যাব।
আমি এই দানবীয় শহর ছেড়ে পালিয়ে আসতে চাই মা। বিশ্বাস করো মা, আমি আজ আর একদমই তোমাকে জ্বালাতন করবো না। বাবার হাতে বকুনিও তোমাকে শুনতে হবে না। আমি তোমায় অবুঝ সন্তানের মতো আরও একবার কাছে পেতে চাই। আর তুমি অতিষ্ট হয়ে বলবে— ‘ওরে পোড়ামুখা’ মর গিয়ে, আমায় আর জ্বালাস না’।
(নোট: যখন মা বেঁচে ছিলেন, পুরো লেখাটি মাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। সেদিন মা’র চোখে কেবল জল দেখেছি। এখনও পৌষ সংক্রান্তি আসবে। কিন্তু মা বেঁচে নেই। মা বিহনে আমার দু’চোখে এখনও জল গড়াচ্ছে!)
আরএ/