দরকার টেকসই সামাজিক পরিবেশ
অধ্যাপক রাজীব হোসেন,বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দূর্যোগ ব্যাবস্থাপনা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ ৫ জুন। বিশ্বব্যাপী কর্মোদ্যোগ, জনঅংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের কার্যক্রম এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে পালিত হয়। বিশেষ এই দিনে জাতিসংঘের পরিবেশ কনফারেন্স শুরু হয়েছিল। তাদের অনেক, অনেক কাজ আছে পরিবেশ উন্নয়ন ও বাঁচাতে। পরিবেশ কনফারেন্সের প্রথম তারিখ হলো-১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন। মোট ১১ দিনের বিরাট, বিপুল ও বিশ্বনন্দিত আয়োজন। এই কনফারেন্স কার্যক্রম প্রতিবছরই করছে জাতিসংঘ। তখন থেকে প্রতি বৎসর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আলাদা, আলাদা প্রয়োজনীয় শ্লোগান ও সার্বজনীন কার্যক্রমে।
গত বছরের কর্মসূচি ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ চলবে টানা ২০৩০ সাল। পুরো এক দশকের অতি প্রয়োজনীয় কর্মযজ্ঞ। বাস্তুসংস্থান অদৃশ্য, দৃশ্যমান দুই ধরনের সুবিধাই আমাদের দিয়ে থাকে। জীবনদায়ী অক্সিজেন, হাজার প্রাণপ্রকৃতির বসবাস, জীবনধারণের জন্য জল, খাবার, মসলা, কাপড়, উপকরণ, আশ্রয়স্থল, ওষুধ সবই আনে পরিবেশ। এই বিশ্বের সব মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতির পুরোটায় অবলম্বন করে পরিবেশকে। সবকিছুর মূলে রয়েছে সবার আলাদা, অপরিহার্য এবং কার্যকর বাস্তুতন্ত্র।
বাংলাদেশে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে আমাদের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগুলো কমে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, সারা বিশ্বেই জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধারে আমরা কম গুরুত্ব দিয়ে চলেছি। ফলে পৃথিবী ত্রিমুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দিন, দিন-জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাসস্থানের অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে। তাতে প্রায় ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ প্রাণ বিলুপ্তিতে। সারা দুনিয়াতে পানি, বায়ু পুরোপুরি দূষণে। বৈশ্বিক এই দুটিসহ পরিবেশের সব সমস্যা ও উত্তোরণ এবং সমাধানের জন্য কাজ করে চলেছেন সবাই। তবে সামগ্রিক সমাধান প্রয়োজন। টুকরো, টুকরো সমাধান পৃথিবীতে এসব সমস্যা অনেক কাটিয়েছে। তবে টেকসই জীবনযাপনের জন্য সামগ্রিক সমাধান করতে হবে। পরিবেশ সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য করণীয় হলো-১. শুধুমাত্র সরকার পারে ক্রস-সেক্টরাল ট্রান্সফরমেটিভ সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে। তাতে অনেক উপকার হবে। আঞ্চলিক, জাতীয় ও বৈশ্বিক সব স্তরেই সরকারই স্থায়িত্ব কার্যক্রমের মূল চালক। তাদের যৌথ ধারাবাহিক নীতি, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্ব পরিবেশের উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রাখে। ২. প্রাকৃতিক অবক্ষয় রোধ ও বন্ধ করতে কাজ করতে হবে। ৩. স্থল ও সাগরের বাস্তুতন্ত্র আবার ফিরিয়ে আনতে সরকারদের জাতীয় ও বৈশ্বিক, বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী পদক্ষেপগুলো নিতে হবে। ৪. অতীতের লক্ষ্যমাত্রাগুলো মিস করা হয়েছে বলে নতুন লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা, আর্থিক সহায়তা ও কার্যক্রমে সম্পন্ন করতে হবে। ৫. জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে ও গ্রিন হাউস ইফেক্ট রোধে প্যারিস চুক্তি অনুসারে দেশগুলোর সরকারদের তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো সম্পন্ন করতে হবে। ৬. বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি শহরে বাস করেন। শহরগুলোকে অতিরিক্ত মানুষের ধাক্কা সহ্য করতে হয়। সরকারকে তাই সামাজিক টেকসই পরিবেশ কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। ৭. এই শহুরে বাস্ততন্ত্র ফিরিয়ে আনতে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বাসস্থান, সহনীয় তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরা, বায়ু দূষণ মোকাবেলার জন্য জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তাদের কাজের কোনো সীমা নেই। শহরগুলোতে জলাভূমি সৃষ্টি, সবুজ করিডোর তৈরি টেকসই প্রাকৃতিক উন্নয়নের অপরিহায শর্ত। যেকোনো স্থায়ীত্বের জন্য জন্য অর্থ বিরাট নিয়ামক। বাংলাদেশের শিল্পকারখানাগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, সৌরবিদুৎ, দূষণ রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রকৃতি ও তার বসবাসকারীদের বাঁচনোর কাজ করতে হবে। বিনিয়োগ অবশ্যই এমন কার্যকলাপে প্রবাহিত করতে হবে, যাতে প্রকৃতি বাঁচে ও পরিবেশের ক্ষতি না হয়। সবার সমৃদ্ধি আসে। উন্নয়নশীল দেশলোকে আরো দীর্ঘমেয়াদের অনুদান দিতে হবে এ খাতে। তাতে তারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা, পরিসেবা, অবকাঠামো ও মানব মূলধন তৈরি করতে পারবেন। ব্যবসায়ী নেতাদের এজন্য আগ্রহী হতে হবে, উদ্যোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা স্কয়ারের এমন কার্যক্রম রয়েছে। বসুন্ধরার আহমেদ আকবর সোবহান, যমুনার নূরুল ইসলাম, হারুনার রশীদ মুন্নু, কুমুদিনী, অঞ্জন চৌধুরীর অবদান সুবিদিত। টেকসই পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিশেষে আমরা আমাদের সমাজ, অর্থনীতির পরিবর্তন করতে পারবো না, যদি না ওপরের কাজগুলো সম্পন্ন করতে না পারি। আগামী প্রজন্মকে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোতে কাজ করতে সাহায্য করে যেতে হবে। জ্ঞান, সরঞ্জাম, কর্ম উদ্যোগ থাকতে হবে। এই কারণেও আমাদের অর্থনীতি ও সমাজের পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানের দরকার। এই শিক্ষা ও জ্ঞান অপরিহার্য।
ছবি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া হরিণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সৌজন্যে।
ওএস।