জীবন ধর্ম ও মানবতা
আমি জীবনবাদী মানুষ। তবে জীবনকে আমি উদযাপন করি আমার কর্মের মাধ্যমে। আমি মনে করি, যে কোন মানুষেরই কাজ করা উচিত। কাজ কর্মহীন জীবন আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হয়। কর্মহীনতা বিষয়টি আমার কখনও ভাল লাগেনি। এখনও কাজ নিয়ে আছি। তবে আজকাল সময়কে কখনো কখনো নিজের প্রতিবন্ধক মনে হয়। সময় চলে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। সমবয়সী বন্ধুদের হারিয়ে ফেলছি। কোভিডে অনেক বন্ধু পরিজন হারিয়েছি। সবমিলিয়ে এখন কেমন যেন থামতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে করে খুব কমই। অনেক কথা বলেছি, অনেক বক্তব্য দিয়েছি। অনেক ছুটেছি। এখন বলতে ইচ্ছে করে না। ছুটতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে বসন্তের বাতাসে বারান্দায় বসে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজেকে ফিরে পেতে ইচ্ছে হয়। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই বোধয় তাই।
মানুষ যা কিছু করে নিজের জন্যই করে। ছেলে-মেয়ে পরিবার সেতো নিজেরই অংশ। পৃথিবীর এই আয়োজনে সে নিজে আর কতটুকু খায়, নিজে আর কতটুকু পড়ে। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের আত্মার সন্ধান করা দরকার। মুখে আমরা যতই বলিনা কেন, আমরা আসলে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। আমরা যেটি পারি, আমরা ছুটতে পারি। ভেতরগত সমৃদ্ধি আমাদের হয় না। আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। আমরা আসলে অনেক কিছুই পারি না। আমরা শুধু আটকে থাকতে পারি, কিন্তু এগিয়ে যেতে পারি না। পৃথিবীতে আজ বিত্তশালীরা সংখ্যায় কত? খুব একটা বেশি না মনে হয়। কিন্তু এরাই সারা পৃথিবীকে দখল করে নিয়েছে। সাধারণ মানুষকে এরা প্রায় দাস বানিয়ে ফেলেছে। একদম গিলে ফেলেছে বলা যায়। এরা যখন ছুটে রাষ্ট্র দখল করে ফেলবে,তখনই হবে বিপর্যয়। এখনও রাষ্ট্রপ্রধানরা পুরোপুরি ব্যবসায়ী হয়ে উঠেনি। এটা ট্রাম্প কেবল শুরু করেছিল। আগেতো মাফিয়া ছিল। মাফিয়ারা পেছনে থাকতো, তাদের প্রতিনিধি থাকতো। এখন স্বয়ং মাফিয়া নেমে গিয়েছে। বিভিন্ন দেশে এদেরই দাপট। এটি হয়তো একশ বছর চলবে। তারপর যদি মোড় ঘোরানো যায়।
তবে এটি সত্য যে, জীবনকে সুশৃঙ্খল করে ধর্ম এবং বিশ্বাস। আমি সাদা-পাঞ্জাবি পায়জামা পরিধান করি বলেই যে, আমি খুব নামাজ রোজা পড়ি এমন ভাবা যদিও ঠিক নয়। আমি সম্পুর্ণ আধুনিক যুগের মানুষ এবং আমাদের পরিবারে ধর্মের যে মূল দর্শন সেটি ব্যাপকভাবেই ছিল। আমার কথা হচ্ছে, ধর্ম পালনে কি হবে যদি না আমি একজন ভাল মানুষ হতে না পারি? আমি খারাপ ধর্ম খুব ভাল, এটিতো কোন সমাধান নয়। তাছাড়া ধর্ম আছে কি নেই, সেটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। এটি নিয়ে বিরোধ কম হয়নি। স্রস্টা আছে কি নেই, তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ কম হয়নি। প্রমাণও করা যায় না, অস্বীকারও করা যায় না। একটি বিরোধ মানুষের মধ্যে চিরকাল ছিল এখনও আছে। আজও ধর্মকে ঘিরে ধ্বংসযজ্ঞ, রক্তপাত থামেনি।
আমি মনে করি, পরিশুদ্ধতার বিষয়টি শিশু বয়স থেকেই তৈরি হয়। পারিবার সেখানে অনেক বড় একটি ভূমিকা রাখে। আমাদের যখন বোধের বিকাশ হয়নি, তখন নানা চিন্তা ভাবনা আমাদের মাথার ভিতর আসে। সেটি ভাল না মন্দ, ভুল না শুদ্ধ, আমরা বুঝতে পারি না। তারপর যখন আমাদের বয়স বাড়ে, চেতনা বাড়ে, তখন আমরা পর্যালোচনা করি। যেমন, একটি উদাহরণ দিই। ভূতকে কেউ কোনদিন দেখে নাই। দিনের বেলায় ভুত দেখা যায় না। রাতের বেলায় সব ভূত বের হয়। আগুনের ফুলকি হয়ে দেখা দেয়। ছোটবেলায় আমাদের ভেতর যে বিষয়গুলো মনের ভিতর গেঁথে ছিল, সেগুলিই বিভিন্নরূপে কখনো ভুতপ্রেত হয়ে আমাদের মস্তিষ্কে রয়ে গিয়েছে। আর ভয়ে আমরা ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেই।
তবে ধর্ম একটি বিশাল ব্যাপার। ধর্ম না থাকলে মানুষ আরও আগেই ধ্বংস হয়ে যেতো। ধর্মই মানুষকে ধারণ করে। মানুষ যে পড়ে যেত, ধর্ম সেখান থেকে মানুষকে রক্ষা করে। আর কালচার তাকে উপরে নিয়ে যায়। উন্নত বোধ সম্পন্ন মানুষে পরিণত করে। মানুষ যখন নানারকম সমস্যায় পড়েছে, তখনই তাঁরা এসেছেন। বিভিন্ন ধর্মেই সেই নজির আছে। আমাদেরওতো এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর। মরুভূমিতে যদি এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর হয়,তাহলে সারা পৃথিবীতে কত সংখ্যক মানবতার কল্যাণে এসেছে সহজেই অনুমেয়। সেজন্যই আলোকিত মানুষ চাই। আলোকিত মানুষ গড়ার অভিপ্রায়ে আমি আগেও কাজ করেছি, এখনও করছি। এখন যেমন লিখছি ‘আলোর ইশকুল’ আমার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা