প্রাচীন বঙ্গের স্থাপত্যকলা ইতিহাস: গোপীনাথ দেব বিগ্রহ মন্দির
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার অন্তর্গত নির্মল ছায়াঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত খোরশেদপুর গ্রামটি শিলাইদহ কুঠিবাড়ি থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। বিখ্যাত পীরদরবেশ ও হযরত খানজাহান আলী (র.) এর প্রেরিত শিষ্য হযরত খোরশেদ-উল-মূল্ক (র.) এর নামানুসারে এই গ্রামের নামকরণ করা হয়।
এখানেই আছে এই পীরের আস্তানা ও মাজার। মাজারের পাশে নাটোরের রাণী ভবানী খনিত বিশাল দুইটি দিঘির একটি অবস্থিত। খোরশেদপুর হাটের কাছে দক্ষিণ দিকে প্রাচীরবেষ্টিত অঙ্গনে একটি পোড়ামাটির ভাস্কর্য মণ্ডিত বাংলা চালারীতির চারচালা রাধারমণ মন্দির ভগ্ন, বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত হওয়ায় ভবনটি ভেঙে ফেলে নতুন দূর্গামন্দির ২০০৪ সালে স্থাপিত হয়েছে। মন্দির চালা এক বিশাল বটগাছের শাখাপ্রশাখায় ও জঙ্গলে আবৃত ছিল। মন্দিরটির আকার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ২০ ফুট এবং উচ্চতায় প্রায় ৩০ ফুট। মন্দিরে প্রবেশদ্বারের উপরে বাঁকানো কার্ণিশের নিচে দুই সারিতে ও দুই পাশে দুই সারিতে মোট ৬২টি কুলুঙ্গিতে পোড়ামাটির মূর্তি-ভাস্কর্য ছিল, যার অধিকাংশই কৃষ্ণলীলা বিষয়ক। এছাড়া, তিনদিকে নানা অলঙ্করণ। মূর্তি-ভাস্কর্য অধিকাংশই বিনষ্ট। অবশিষ্ট ফুলকারি ও জ্যামিতিক নক্শার ভাস্কর্যগুলি প্রাচীর বেষ্টনীর প্রবেশদ্বারের দুই পাশে কিছুদিন আগে নিবদ্ধ করা হয়েছে। এই প্রবেশপথটি প্রায় ১৫ হাত উঁচু কপাট শোভিত। চারিদিকে টেরাকোটা ইটে সন্যাল পদ্ম, চক্র, লতা, পশু, পাখি, ফুল, পাতা ও দেবদেবীর মূর্তি শোভিত বিভিন্ন নক্শার কারুকার্য বেষ্টিত। এর মধ্যে হাতি, ঘোড়া, গরু, পাখি, গোল আকৃতির বিভিন্ন নক্শা ফুলসহ নানা কারুকার্য দৃষ্টি কাড়ে। মূল ভবনের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে একটি বিশাল মঠ। মঠটি সীতারামের। মঠের সামনে ঐসময়ের কীর্তন পরিবেশন ভবনটি এখন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত। কথিত আছে, ভবনটি অতিথিশালা ও বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার হতো। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ শেষে ডান পার্শ্বে ঘুরে ডানদিকে রয়েছে অতিথিশালা।
মঠ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন গোপীনাথ বিগ্রহ। এই মন্দিরটি কালের কবলে বিধ্বস্ত হলে পাশেই পাঁচটি ফুলকাটা খিলানের দুইটি সারি সংযুক্ত প্রশস্ত পঙ্খ-অলঙ্কৃত পাশদুইটিতে পরীর ভাস্কর্য স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী গোপীনাথ দেব বিগ্রহ (দেবপ্রতিমা) দালান মন্দির নাটোরের রাণী ভবানী কর্তৃক নির্মিত হয়। নির্মাণ আর স্থাপত্য নিদর্শনের এক অপূর্ব সৃষ্টি গোপীনাথ মন্দিরের স্থাপত্য কারুকার্য কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই এর শিল্পনৈপূণ্য কত মাধুর্যময়! মাঝে নবনির্মিত লোহার গ্রীল; গ্রীল পেরুলে বাম পাশে কাঠের রথ রয়েছে, আর ডান পাশে রয়েছে কাঠের সিংহাসন। ভিতরে রয়েছে গোপীনাথের মূল বিগ্রহটি। এই মন্দিরে চারশত বছরের পুরাতন শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি ছিল যা ভগ্ন হওয়ায় পূজা করা হয় না। নতুন স্থাপিত রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি আছে যার নিত্যপূজা হয়।
এই মন্দিরে কষ্টি পাথরের রাধারমণের বিগ্রহ ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকসেনারা বিগ্রহটি ধ্বংস করার পর বর্তমান পর্যন্ত নতুন কোন বিগ্রহ নেওয়া হয়নি। চালা মন্দিরের পোড়ামাটির কিছু ভাস্কর্য দালানমন্দিরে সংযুক্ত আছে। বাংলা হরফে পোড়ামাটির সংস্কৃত প্রতিষ্ঠালিপিফলক দালানমন্দিরে নিবদ্ধ। লম্বা ১৩ সেন্টিমিটার ও প্রশস্ত ১৯ সেন্টিমিটার আকারের প্রতিষ্ঠালিপির পাঠ:
...যে সাগরশায়ক ঋতু
শীতাংশু চাত: শকে...গতেষু
শ্রীহরে গৃহং শয়ন প্রথাং
কীর্ত্তি: স্থিতৌ। ত্রিনেত্রপতি: রাম
কান্ত নৃপতি না নির্ম্মমে সংস্থপত্যগ্রণী
শ্রী...নাথ জগত: পতে: স্থপতিভি:
...মাদায় নির্ম্মমে...নাথ
... ... ... ... ... ... ...
এই প্রতিষ্ঠাফলক অনুযায়ী ১৬৫৭ শকে (সাগর ৭, শায়ক ৫, ঋতু ৬ ও শীতাংশু ১, অঙ্কের বামাগতি অনুযায়ী ১৬৫৭) অর্থাৎ ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রাণী ভবানীর পতি রামকান্ত রায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাফলকের শেষাংশে মন্দিরনির্মাতা স্থপতির নামধাম উল্লেখ আছে। অক্ষরগুলি ভেঙে যাওয়ায় এবং বারবার প্রতিষ্ঠাফলকে রঙ করায় পাঠোদ্বার এখন অসম্ভব। এই মন্দিরলিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার হলে মন্দির নির্মাতা শিল্পীর পরিচয় উদ্ঘাটিত হত। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী তাঁর ‘শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘...ভগিনী নিবেদিতা গেলেন শিলাইদহের বিখ্যাত গোপীনাথ ঠাকুর মন্দির ও দেবদর্শন করতে। ...গোপীনাথের প্রাচীন মন্দির দুটি রাজা সীতারাম রায়ের তৈরি, নতুন মন্দিরটি রাণী ভবানীর তৈরি। ...সেকালের নানা শিল্পকলার নিদর্শন রয়েছে সেই মন্দিরের পাতলা ইটগুলোতে। কয়েকখানা পুরোনো ভেঙেপড়া ইটও সযত্নে সংগ্রহ করে সঙ্গে নিলেন।’ প্রাসঙ্গিক উল্লেখ্য যে ভগিনী নিবেদিতা ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে পক্ষকাল ছিলেন।
দালানমন্দিরে গোপীনাথের স্নানযাত্রা ও দোলের অষ্টকোণাকৃতি কারুকার্যমণ্ডিত মঞ্চ আছে, দারুতক্ষণশিল্পের নিদর্শন। দালানমন্দিরে এখন শালগ্রাম শিলা নিত্যপূজিত। দালানমন্দিরের সামনে অসমাপ্ত নাটমন্দির, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দে নির্মিত হয়। প্রাচীনবেষ্টনীর প্রবেশদ্বারও অলঙ্কৃত। বাইরে দুটি দোলমঞ্চ, একটি সংলগ্ন, অপরটি একটু দূরে মূল মন্দিরের বাহিরে পশ্চিম দিকে। মঞ্চ দুইটি অষ্টকোণাকৃতি ইটের তৈরি। স্থাপত্যটির বেদীতে মাথাসহ হাতির শুঁঁড়ের আদলে তৈরি সাতধাপের সিঁড়িঁসহ রেলিং আছে। ‘তাঁতী কল্যাণ রায়’ ছিলেন ধর্মপ্রাণ জমিদার। তাঁর আরাধ্য গোপীনাথ বিগ্রহ রাজা সীতারাম রায় চারচালা মন্দির নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দির ধ্বংস হলে রাণী ভবানী দালানমন্দির নির্মাণ করেন ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে। নতুন প্রজন্মের স্থানীয় রঞ্জু আহমেদ বলেন, ‘আষাঢ় মাসে এখানে এ পূজাকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। শত শত নারী-পুরুষেরা ঘট ভর্তি ঘোল আর নানা রকম প্রসাদ নিয়ে হাজির হয় এখানে।’ মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে দূর্গা মন্দির যা ২০০৪ সালে তৎকালীন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. সৈয়দ আহসানুল হক নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পাশ্ববর্তী আড়পাড়া নিবাসী মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল জব্বার এবং মো. বিল্লাল বিশ্বাস বলেন, গোপীনাথ মন্দিরের বাইরে একটি বাইজি খানা ছিল যা সখিপুর নামে পরিচিত। এই মন্দির যে, তাঁতী কল্যাণ রায় কর্তৃক দানকৃত জমির উপর রাণী ভবানী উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সেই বিষয়ে তিনিও একমত হন। শিলাইদহে বিশ্বকবির কুঠিবাড়ি পরিদর্শনে এসে শ্রী শ্রী গোপীনাথ দেব বিগ্রহ মন্দির দর্শন না করলে পর্যটকগণের আত্মতৃপ্তি অপূর্ণই থেকে যায় বটে!
বিস্তারিত জানতে: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন ও ড. সারিয়া সুলতানা, ‘ধর্মীয় ইতিহাস স্থাপত্যে কুষ্টিয়া’, প্রথম প্রকাশ, কণ্ঠধ্বনি প্রকাশনী, কুষ্টিয়া, একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০
খুজতে হলে: https://www.rokomari.com/search?term=কণ্ঠধ্বনি+প্রকাশনী
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক