বিশেষ নিবন্ধ
‘রোহিঙ্গা’ নামক অপচ্ছায়া মুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে মিয়ানমারের মানবাধিকার এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে। এটি ইতিবাচক একটি অগ্রগতি মনে হলেও একইসঙ্গে খুব বেশি উৎসাহিত হতে পারছি না। কারণ, এই প্রস্তাবের কার্যকারিতার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই যা মনে হয়, রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের জন্য মিয়ানমারের উপর উপযুক্ত পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যেমন চীন, রাশিয়া এবং সেই সঙ্গে জাতিসংঘের অন্য এবং আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র যেমন চীন, জাপান, ভারত, ভুটানসহ আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো। এদের সঙ্গে আমাদের আরও নিবিড় একটি সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হবে। তার কারণ হলো, এই দেশগুলো বিশেষ করে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি গভীর কৌশলগত সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। আমার কাছে মনে হয় যে, চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের এই সম্পর্কের মূল্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
চীন যদিও বলে যে, তারা এটির সমাধান চায় কিন্তু বাস্তব অর্থে তাদের এই চাওয়াটি যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী নয়। যা আমাদের জন্য খুব একটা আশা জাগাতে পারছে না। সেই জায়গায় চীনকে আমাদের আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে।
রাশিয়াকেও আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক সহযোগিতা সপ্রসারিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে থেকে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করতে চায়। কাজেই রোহিঙ্গা ইস্যুর চেয়ে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কটি তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তাদের ভূমিকা খুব একটা শক্ত অবস্থানে নেই অনুমান করা যায়।
ভারতের কথা যদি বলি, ভারত চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চিন্তার দিক দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এজন্য তারা মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ দিতে চায় না। কারণ, তাতে মিয়ানমার চীনের দিকে চলে যাবে। ভারত আমাদের পক্ষ সমর্থন করলেও মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কটুকু নাজুক করতে রাজি নয়। বলা যায়, ভারত দ্বি-মুখী খেলায় মগ্ন।
জাপান আমাদের দ্বি-পাক্ষিক বন্ধু। তবে জাপানও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটামুটিভাবে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ অবলম্বন করেছে। যদিও সম্প্রতি সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর জাপানের অভ্যন্তরে কিছুটা পরিবর্তন দেখছি। পরিবর্তনটা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
আশিয়ান দেশগুলো এ ব্যাপারে খুব সাবধানী ভূমিকা পালন করছে। আশিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কিন্তু মোটামুটিভাবে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার নাম করা যেতে পারে।
এখন কথা হলো, আমরা কি করতে পারি বা কি করলে এই সমস্যার সমাধান হবে? এই ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমি উল্লেখ করব, একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতেও মিয়ানমারে যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তা তুলে ধরে সমাধানে সচেষ্ট থাকতে হবে। সেই সঙ্গে চীন, ভারত, রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরালো করতে হবে। সেক্ষত্রে আমাদের হাতে যে কিছু উপকরণ নাই তা আমি বলব না। সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
যেমন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। ভারতের সঙ্গে আছে, জাপানের সঙ্গে আছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিতকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিশেষ কোনো উদ্যোগ এখনও নিতে পারছি না। কাজেই এই জায়গাটি ব্যবহার করার কথা আমরা চিন্তা করতে পারি কি-না সেটি বিবেচনা করা দরকার। এটি সম্ভব হলে এই দেশগুলো দ্বি-পাক্ষিকভাবে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও আমরা খুব একটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। সেখানেও একটি ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করে মিয়ানমারে যে সমস্যাগুলি বিশেষ করে রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদে ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে জাতিসংঘ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে আমাদের সহায়তা করতে পারে।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পরে আশিয়ানদের ভিতরে কিন্তু একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। তাদের বিভিন্ন শীর্ষ বৈঠকগুলোতে মিয়ানমারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কয়েকদিন আগে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের যে সামিট হয়েছে, সেখানে চীন কিন্তু চেষ্টা করেছিল আশিয়ানকে অনুপ্রাণিত করতে মিয়ানমারকে যেন সেখানে রাখে। কিন্তু আশিয়ান কড়াভাবে বলে দিয়েছে যে, তারা সেটি চায় না। তারা চায় না মিয়ানমারের সামরিক সরকার এখানে আসুক । এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি। মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একটি জনমত তৈরি হচ্ছে। সুচির দল পাল্টা সরকার গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। আশিয়ানদের মতো একটি শক্তিশালী সংগঠন মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলছে। এই গণতন্ত্রায়নের সঙ্গে যদি রোহিঙ্গা ইস্যু জুড়ে দেওয়া যায়, যদি বুঝানো যায় যে, মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল জাতি-গোষ্ঠীর স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করাটা জরুরি। এই ধরনের একটি জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারলে এবং আশিয়ানদেরকেও সম্পৃক্ত করতে পারলে মিয়ানমারের গন্তন্ত্রায়নের ক্ষেত্রে যে নতুন একটি সম্ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমাদের সৃজনশীল ও কূটনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে সফল হতে পারি। আমরা যদি সেটা করতে পারি সেক্ষেত্রে সমাধানের একটি দিক নির্দেশনা আমরা খুঁজে পাবো।
একথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যু সবচেয়ে বড়, জটিল এবং চ্যলেঞ্জিং একটি সমস্যা। এটি শুধু মানবিক সমস্যা নয়। আগামীদিনে এটি সামাজিকভাবে নিরাপত্তার দিক থেকে একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিবে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান আমাদের জরুরি হয়ে পড়েছে।
এক্ষেত্রে আরও একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের এই সংকটের যদি সম্মানজনক সমাধান করতে পারি তার মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক এবং মিয়ানমারের মাধ্যমে আশিয়ানদের সঙ্গেও আমাদের নতুন সম্পর্কের বিন্যাস তৈরি করা যেতে পারে। এটি আগামী পঞ্চাশ বছরের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারা বিস্তারের প্রাক সমাধান।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
অনুলিখন: শেহনাজ পূর্ণা
এসপি/এএন