ইভিএম নিয়ে সন্দেহ, সংশয় এবং সিদ্ধান্ত
রাজনীতি জীবনের সমস্ত দিক ছুঁয়ে যায় বা সব দিকে ছেয়ে আছে। এ কথা মানুন বা না মানুন— রাজনৈতিক আলোচনা এমন একটি আকর্ষণীয় বিষয় যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করে। যারা বলতে পছন্দ করেন, আমি ভাই রাজনীতি পছন্দ করি না তারাও নিজের কথিত অপছন্দ সত্ত্বেও রাজনীতির আলোচনাতেই ঢুকে যান অবলীলায়। বিতর্ক করেন, উত্তেজিত হন এবং শেষে বলেন, এ জন্যেই কিন্তু আমি রাজনৈতিক আলোচনা করতে চাই না। তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় রাজনীতি অর্থনীতির ঘনীভূত রুপ।
বাংলাদেশে এই রাজনীতি ঘনীভূত হয় নির্বাচনে। ফলে রাজনৈতিক আলোচনা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় নির্বাচনের আলোচনায়। চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে সংসদীয় বিতর্ক, রাস্তার আলোচনা থেকে রাষ্ট্রপতিভবন সব জায়গায় আলোচনা গিয়ে ঠেকে নির্বাচন কেমন হয়েছে বা নির্বাচন কেমন হবে এই জায়গায়।
দ্বাদশ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ। নির্বাচন বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যুক্ত। কারণ বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ৭০ এর নির্বাচনের পর। এই নির্বাচনের বিজয় যুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি রচনায় নির্বাচন, গণরায় এবং সেই অনুযায়ী দেশ পরিচালনার আকাঙ্ক্ষা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারা কি এতদিনের ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা নয়? এগারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা হয় ১৯৯১, ১৯৯৬ এর জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনকে। এই চারটি নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ছিল নির্বাচনকালীন যে সরকার ছিলেন তারা নিজেরা নির্বাচনে অংশ নেননি। তারা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। ফলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না, গ্রহণযোগ্যতাও পায় না।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পটভূমিতে ২০২৩ সালের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে জুলাই মাসে ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় ইসি। এতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কমিশনের সঙ্গে বসে সময় নষ্ট না করার কথা বলে তাদের মতামত লিখিতভাবে পাঠিয়ে দেয়। বিএনপিসহ ১১টি দল মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেনি। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বাকি ২৮ দলের সংলাপে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক প্রস্তাব আসে ইসির কাছে। সংলাপে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২টি দল কোনো মতামত দেয়নি। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদসহ ১২টি দল শর্ত সাপেক্ষে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেছে। জাতীয় পার্টিসহ ১০টি দল সরাসরি ইভিএম এর বিপক্ষে মত দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, বিকল্প ধারা ও তরিকত ফেডারেশন ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে। সংলাপে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে এবং তরিকত ফেডারেশন ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেছিল। ইভিএম নিয়ে মতামতের প্রশ্নে দলের সংখ্যা বিবেচনায় ইভিএমের সমর্থনের চাইতে বিরোধিতাকারীর সংখ্যাই বেশি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ইভিএমে যাওয়ার একটা বড় সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেদের। ভোট হ্যান্ডল করবে রাজনৈতিক দল নয়, ভোটকে হ্যান্ডল করবে ইসি।’ এই সিদ্ধান্ত কীভাবে বা কোন বিবেচনায় নিলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘যারা ভোট দিতে আসবেন, সেটা আমাদের মুখ্য বিবেচনায় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো কে কী বলেছে, সেটা আমাদের মুখ্য বিবেচনায় আসেনি। কিন্তু বক্তব্যগুলো বিবেচনায় নিয়েছি। একই সঙ্গে যেসব ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগে কেন্দ্রে আসেন, তারা যেন আরও ভালোভাবে ভোট দিতে পারেন, তা বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
বিষয়টা গোলমেলে হয়ে গেল না কি? অতীতের মত আবার বিতর্কের জন্ম দিলেন ইসি। তার বক্তব্য অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত মুখ্য নয় তাহলে প্রশ্ন আসে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করলেন কেন? বলছেন, যারা ভোট দিতে আসবেন তাদের মতটাই মুখ্য। তাহলে ১০ কোটি ৯১ লাখ ভোটারের মধ্যে কতজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন ইসি? নির্বাচন কমিশন গঠনের পর শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে ইসি। পত্রিকায় যতটুকু খবর এসেছে তাতে তাদের বেশিরভাগই ইভিএম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাদের সংশয় দূর করার কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্ক বাদ দিলেও ইভিএম ব্যবহারে ইসির সক্ষমতা কত সে প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশন সচিব জানান, বর্তমানে ইসির হাতে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে। অশোক কুমার বলেন, ‘আমাদের কাছে যা ইভিএম রয়েছে তা দিয়ে ৭০-৮০টি আসনে নির্বাচন করা সম্ভব। বাকি আসনগুলোর জন্য নতুন করে যন্ত্র কিনতে হবে ইসিকে। প্রয়োজনে ইভিএম কেনার জন্য নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে।’
তারমানে আবার কেনাকাটা? গতবারের কেনাকাটা নিয়ে অর্থাৎ যন্ত্রের মান ও দাম নিয়ে স্বচ্ছতার অভিযোগ ছিল। এবার কী হবে? এই আশঙ্কা থাকছে।
ইভিএম নিয়ে আলোচনা চলছে অনেকদিন ধরে। অতীতের কিছু ঘটনা নিশ্চয়ই আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়নি। ইভিএম বিষয়ক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি ইভিএমের কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করে ইভিএম কেনায় সম্মতি দেননি। কারণ এই ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল নাই। ফলে একবার ফল প্রকাশ হলে তা যাচাইয়ের আর সুযোগ থাকে না। কোনো প্রার্থী যদি ফলাফল চ্যালেঞ্জ করতে চায় নির্বাচন কমিশন তাহলে নির্বাচন কীভাবে প্রমাণ করবেন যে গণনা ভুল হয়নি? কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ ইভিএমকে বিশ্বাস করতে হবে। আর ইভিএমকে বিশ্বাস করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থার সংকট না দূর হলে ইভিএম নিয়ে সংশয় কাটবে কীভাবে?
ইভিএমে দুইটি অংশ থাকে। একটি ভোটার আইডেন্টিফিকেশন ইউনিট আর একটি ব্যালট ইউনিট। ফলে একজন ভোটার ইভিএমে আইডেন্টিফাই করার পর অন্য কেউ ব্যালট ইউনিটে চাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এইসব আশঙ্কার কথা বলেছেন নাগরিক এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকে। রাজনৈতিক দলের কথা বিবেচনায় নিলেন না, সাংবাদিক, নাগরিক, শিক্ষাবিদদের আশঙ্কাকে আমলে নিলেন না, নিজেরা যা ভেবেছেন সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাহলে কি গ্রামীণ সেই প্রবাদটি নির্বাচন কমিশন মেনে চললেন? আমার কথা আমিই কই, তোরে শুধু জিগায়া লই। মতামতকে না হয় উপেক্ষা করলেন কিন্তু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি এবং ইভিএম ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বাস্তবে সক্ষমতার প্রমাণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন কি নির্বাচন কমিশনের আছে?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
আরএ/