আন্দোলনে চা শ্রমিক, কেন এই উপেক্ষা
গত ১৩ আগস্ট থেকে মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম মিলে ১৬৭টি চা বাগানের শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি তিনশো টাকাসহ সাত দফা দাবিতে একসঙ্গে নেমেছে। প্রতি দুই বছর পর পর চা শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এটা হয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে। ২০১৯-২০ মেয়াদের চুক্তির সময়সীমা শেষ হয়েছে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা কিন্তু ২০ মাস চলে গেল এখনও চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। চুক্তিস্বাক্ষরের দাবিতে প্রথমে কয়েকদিন দুই ঘণ্টা করে কর্ম বিরতি করেছিলেন তারা। কর্তৃপক্ষ তাদের দাবিতে কর্ণপাত না করায় কাজ বন্ধ করে দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন তারা। প্রতি সপ্তাহে মজুরি পাওয়া শ্রমিকরা কতদিন আর অভুক্ত অবস্থায় আন্দোলন করবে এই চিন্তা থেকে আলোচনা দফায় দফায় অসমাপ্ত রাখছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনড়, কাজ করে হতদরিদ্র থাকা নয়, তাদের দাবি বাঁচার মত মজুরি চাই।
চা বাগানের পাতা তোলার একটা নির্ধারিত পরিমাণ আছে। কোনো বাগানে প্রতিদিন কমপক্ষে বিশ কেজি, কোনো বাগানে তেইশ কেজি আবার কোথাও পঁচিশ কেজি চা পাতা তুলতে হয়। বেশিরভাগ চা বাগানে কমপক্ষে তেইশ কেজি চা পাতা তুলতে হয়। একে বলা হয় নিরিখ। এই নিরিখ পূরণ করলে এ-গ্রেডের বাগানে ১২০ টাকা, বি- গ্রেডের বাগানে ১১৮ টাকা আর সি- গ্রেডের বাগানে ১১৭ টাকা মজুরি পান তারা। এর বাইরে স্থায়ী শ্রমিকদের জন্য সপ্তাহে ৩.২৭০ কেজি, স্ত্রী পোস্য ২.৪৪ কেজি, নির্ভরশীল ১ থেকে ৮ বছর বয়সীদের জন্য ১.২২ কেজি এবং ৮ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য ২.৪৪ কেজি চাল বা আটা পায়। বসবাসের জন্য ঘর আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবাদ করার জন্য এক টুকরো জমি এই তাদের বরাদ্দ। তবে জমি চাষ করলে সে আবার রেশন পাবে না। একজন শ্রমিক মাসে কত রেশন পান? চাল অথবা আটা ৩৫ থেকে ৩৬ কেজি। যার বাজার মূল্য ১৭০০ টাকা। তাহলে দিনে ১২০ টাকা মজুরি হলে মাসে প্রতিদিন কাজ করলে মোট ৩৬০০ টাকা, রেশন বর্তমান বাজার দরে ১৭০০ টাকা।
এই টাকায় স্বামী, স্ত্রী দুই সন্তান কিভাবে বেঁচে থাকে। আসলে তারা বেঁচে থাকে চা শ্রমিকদের মত করেই। যাদের জীবনের সঙ্গে কারো জীবন মেলে না।
কি দিয়ে কি পায় চা শ্রমিকরা?
দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলে একজন শ্রমিক। প্রতি ৪ কেজি কাঁচা চা পাতা থেকে ১ কেজি চা হয়। তাহলে চা শ্রমিকরা দিনে ৬ কেজি চা বানানোর উপযোগী চা পাতা তোলেন। ৬ কেজি চায়ের দাম ২০০ টাকা কেজি হলে কমপক্ষে ১২০০ টাকা দাম হয় । চা শ্রমিক মজুরি আর রেশন আবাসন মিলে পায় ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। কখনো এই হিসেব কি হয়েছে চা শ্রমিকদের মূল্য সংযোজন কত। চা উৎপাদনে খরচ কত? অন্যদিকে মালিকরা রাষ্ট্রের কাছে কি পান? তাদের জমির জন্য কত খাজনা দিতে হয়? বাগান দেখিয়ে ঋণ পাওয়ার সুবিধা কত?
কেন এই আন্দোলন? ১২০ টাকার দিন, চলতে তো চায় না
চা-শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালান। তাদের শরীরের দিকে তাকালে জীবনযাপনের কষ্ট কেমন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত দুই বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ভালো খাবার তো দূরের কথা দৈনন্দিন বাজার করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য বিভিন্নভাবে ঋণ করতে হয়। চা-বাগানের চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই খারাপ। কোনো রোগী অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। চা-বাগানে নারী শ্রমিকদের শৌচাগার নেই। এ জন্য চা-বাগানের ভেতরেই শৌচকর্ম সারতে হয়। চা-বাগানের নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি কম পান, গর্ভবতী নারীরা পেটে সন্তান নিয়েও কাজ করেন। ছোট ছোট মিত্তিঙ্গা টাইপের ঘর যার আয়তন ২১ ফুট বাই সাড়ে ১০ ফুট সেই ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসবাস তাদের। রাগে ক্ষোভে শ্রমিকরা বলছেন কাজ করি ভালোভাবে বাঁচার জন্য। এত কষ্টে কাজ করেও বাঁচার মত মজুরি যদি না পাই, তাহলে চা-বাগানের কাজ করব কেন? কম মজুরির প্রভাব তাদের জীবনে মারাত্মক। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায় অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়, স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭.৫ শতাংশ। ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে যায় ৪৬ শতাংশ কিশোরীর, ন্যূন্নতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই চা বাগানের ৬৭ শতাংশ। তারপরেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকে চা শ্রমিকরা। কারণ যাওয়ার কোনো জায়গা যে নেই। এটাই মালিকদের জন্য সুবিধা আর শ্রমিকদের অসহায়ত্ব।
চা পানে ক্লান্তি দূর হয়, কিন্তু এই ক্লান্ত মানুষদের ক্লান্তি দূর হবে কীভাবে?
পিঠে ঝোলানো ঝুড়ি, মাথায় পাতার বোঝা, ক্লান্ত শ্রমিক দাঁড়িয়ে থাকে পাতা ওজন ঘরের কাছে। যে চা সবার ক্লান্তি দূর করে সেই চা শ্রমিক সকালে কাজে যায় রুটি, বাসায় বানানো লবন চা আর চা পাতার ভর্তা নিয়ে, দুপুরে খাবে বলে। গাছের নিচে বসে কোনোমতে খেয়ে নিয়ে আবার পাতা তোলার কাজ। পুষ্টিহীন ক্লান্ত শরীর, হাত চলতে চায় না। কিন্তু নিরিখ পূরণ করতেই হবে। বাজারে এক কেজি চাল ৫০ টাকা, একটা ডিম ১২ টাকা, এক কাপ লাল চা ৬ টাকা। ইচ্ছে হলেও খাওয়ার উপায় কি? অপুষ্টি আর ক্লান্তি জমতেই থাকে শরীরে দিনের পর দিন। একজন দিন মজুরের জন্য মজুরি নির্ধারণ হয়েছে যখন ৬০০ টাকা তখন চা শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ টাকা চাইলে আঁতকে উঠবেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণে এত গড়িমসি কেন? দেশের প্রান্তে পড়ে থাকা মানুষগুলো কি ক্লান্ত পায়ে চায়ের বোঝা টেনেই যাবে প্রতিদিন।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
আরএ/