‘হিরা ফেলে কাঁচ তুলে’
পৃথিবীর কোনোকিছুই ফেলনা নয়। আমাদের ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিসের মূল্য থেকেই যায়। আমরা একটি জিনিস ব্যবহার করতে করতে শেষ হয়ে গেলে ফেলে দিই। সমস্ত খাদ্য উপাদানের একটি অংশ উচ্ছিষ্ট গণ্য করে ফেলে দিই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে খাদ্যের বেশিভাগ অংশই অপচয় করা হয়। একইভাবে আমাদের দেশে একটি গাড়ি ব্যবহার করতে করতে অচল হয়ে গেলে সেটি আমরা কোথাও ফেলে রাখি। বাংলাদেশের সব সরকারি দপ্তরের আনাচে কানাচে পুরোনো গাড়ি পড়ে থাকে। তাতে আবর্জনা ও আগাছা জমতে জমতে এক ভৌতিক ও স্থির বস্তুতে রূপ নেয়। ট্রাফিক পুলিশের দপ্তর ও থানায় অসংখ্য গাড়ি ও মোটরসাইকেল একইরকম স্থির আবর্জনা হয়ে পড়ে থাকে। এগুলো ওই দপ্তরের পরিবেশ যেমন নষ্ট করছে একইভাবে সম্পদের অপব্যবহারের নজির সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সমস্ত ফেলনা বস্তুকেই সম্পদে রূপ দিতে পারি। প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছু ফেলছি। যেটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়, তা একটি প্রক্রিয়ায় পচে গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশকে বিষময় করে তোলে। আর যেটি মাটিতে মেশে না সেটি শত বছরের অভিশাপ হয়ে এদিক সেদিক পড়ে থাকে। শুধু এভাবেই আমাদের সবুজ শ্যামল সুন্দর দেশটি বসবাসের অনুপযোগী একটি দেশে পরিণত হচ্ছে।
গাড়ি, মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে লোহার সব জিনিসই পরিণত হতে পারে অন্য কোনো ধাতব পদার্থে। আমাদের মেটাল ইন্ডাস্ট্রিগুলো বাইরে থেকে বিপুল অংকের টাকার কাঁচামাল আনে, অথচ এসব কাঁচামালের যোগাড় রয়েছে দেশেই। তা ছাড়া যে গাড়ি আমরা ফেলে নষ্ট করছি, তার বিভিন্ন পার্টস অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় স্তম্ভ গার্মেন্টস শিল্প। এ শিল্প থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আবর্জনা বের হচ্ছে। শিল্পের আবর্জনা থাকবেই কিন্তু সেই আবর্জনাকে আরেকটি পণ্যে রূপ না দিতে পারলে তার বোঝা পৃথিবী বইতে পারবে না। শুধু গার্মেন্টস বর্জ্য ও আবর্জনাকে কাজে লাগাতে গিয়ে আমরা নতুন করে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারি। একইভাবে পারি বর্জ্য থেকে নানান দরকারি পণ্য তৈরি করতে। এখানেই লুকিয়ে আছে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। অথচ আমরা সে সম্ভাবনার দিকে না তাকিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য কত সহজে কোথাও ফেলে দিতে পারি, সেই চেষ্টা করে থাকি। আমরা হয়তো কোনো নদীতে, পুকুরে বা রাস্তার পাশের নর্দমায় ফেলছি। এতে শুধু নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় পরিবেশের ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনছি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ বিপর্যয়ের গল্প অনেক পুরোনো। এর যতরকম নেতিবাচক দিক আছে সবগুলোর শিকার হচ্ছে ঢাকা শহরের অধিবাসী তথা সারাদেশের মানুষ। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কোনো উচ্চতর বিজ্ঞান নয়। এটি মানুষের আয়ত্বের মধ্যকার একটি ব্যবস্থাপনা। আমরা সহজ হিসেবে বুঝতে পারি, পায়ের জুতোটি পুরোনো হয়ে গেলে আমরা ফেলে দিই। কিন্তু সেই জুতোটি আমরা কোনো একটি পুরোনো জুতোর দোকানে দিতে পারি। সেটি স্বল্পদামে কেউ কিনে ব্যবহার করছে। তারও ব্যবহার শেষে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যদি জমা দেয়, তাহলে সেখান থেকে সংগ্রহ করে তা আরেকটি শিল্পপণ্যের কাঁচামাল হিসেবে সরবরাহ করতে পারি।
শুধু মনোযোগের ব্যাপার। একটি পণ্য ব্যবহারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার দিকে মনোযোগ রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আপনি আমি হয়তো পণ্য ব্যবহারের দিকে মনোযোগী কিন্তু ব্যবহার শেষে তার অবশিষ্টাংশ বা বর্জ্যের ব্যাপারে মনোযোগী নয়। আমাদের এই উদাসীনতা বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে যেমন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, একইভাবে বিশাল এক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিতে দৃষ্টিপাত করতে দিচ্ছে না। তার মানে আমাদের উদাসিনতা প্রতিনিয়ত আমাদের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সমাজের ওপর, জনস্বাস্থ্যের ওপর। সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়ছি আমরা।
দেখুন, আমাদের দেশে ডেঙ্গু কেন হচ্ছে? জলবায়ু ও পরিবেশগত সব কারণের ঊর্ধ্বে রয়েছে আমাদের উদাসীনতা। আমাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের অবশিষ্টাংশ বা ভাঙড়ি আমরা যত্রতত্র ফেলে দিচ্ছি। তার মধ্যে পানি জমে, সেখানে এডিস মশা বংশ বিস্তার করছে। অথচ আমরা ব্যবহৃত সব উপকরণের অবশিষ্টাংশ গুছিয়ে আপনি আরেকটি পণ্য তৈরির জন্য সচেতনভাবে দিতে পারেন। প্রতিদিনের উচ্ছিষ্ট বর্জ্যের সঙ্গে তা অপসারণের নির্দিষ্ট ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা গেলে, সেখানে বাছাই করা ও বর্জ্য থেকে শিল্পপণ্যে পরিণত করার ব্যবস্থাটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক পরিকাঠামো হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। যা একটি শহরের সৌন্দর্য সৃষ্টির পেছনের সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
আমাদের দেশে ব্যবস্থাগুলো অল্পবিস্তর আছে বটে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি অপ্রতুল। তাও অব্যস্থাপনা ও অনিয়মে পূর্ণ। আমরা সবকিছুর জন্য সরকারের দিকে চেয়ে থাকি। আমরা সব ব্যাপারে সরকারকেই দায়ী করি। প্রাজ্ঞজনেরা অনেক বিষয়ে সরকারের উদ্দেশ্যে মূল্যবানে উপদেশবাণী দিয়ে থাকেন কিন্তু সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে দেন না। আমি ৩২ বছরের অধ্যবসায় ও প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সব ব্যাপারে সরকারের দিকে চেয়ে থাকার চেয়ে বড় বোকামি বা অলসতা আর নেই। সরকার সবকিছু করে দেবে না। সরকারের সহায়ক হিসেবে, জনগণের সহায়ক হিসেবে ব্যক্তি পর্যায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে। কাউকে না কাউকে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভেতরে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের দিকটিকে বড় করে দেখতে হবে। দেশ ও জনগণকে বিশাল ক্ষতি থেকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করতে হবে। একইসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে বিশাল অর্থনৈতিক সাফল্য। এটি শুধু সত্যিকারের দূরদৃষ্টির ব্যাপার, আর কিছু নয়।
যতদূর জানি বাংলাদেশে বছরে ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য বের হচ্ছে। এ প্লাস্টিক বর্জ্যকে জ্বালানিতে রূপ দিতে পারলে কমপক্ষে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মূদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। আবার বাংলদেশে যেসব প্লাস্টিক পণ্য তৈরি হয়, তার সব কাঁচামালেই বাইরে থেকে আসছে। অথচ আমরা আমাদের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করেই সেই চাহিদা পূরণ করতে পারি।
বাংলাদেশে বড় বড় হোটেল রয়েছে প্রতিদিন প্রচুর খাদ্য অব্যবহৃত থাকে ও উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। খাদ্যগুলো সব সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অনায়াসেই বায়োগ্যাস ও কম্পোস্ট সার তৈরি করা সম্ভব। কেউ কেউ খুব ছোট পরিসরে বিচ্ছিন্নভাবে এমন আয়োজন করেন বলে শুনি, কিন্তু সমন্বিতভাবে না করলে তা মোটা দাগে জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারবে না। ধরুন ঢাকার কারওয়ান বাজার। এখানে প্রতিদিন কী বিপুল পরিমাণ সবজিপণ্যের বর্জ্য বের হচ্ছে। এগুলোর কার্যকর কোনো ব্যবহার নেই। এগুলো সবই একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা গেলে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন, জৈব সার উৎপাদন ব্যবস্থাগুলো আমাদের হাতেই ধরা দেবে। সেগুলো আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে, কী পরিমাণ বর্জ্য ব্যবহার করে আমরা বায়োগ্যাস ও জৈব সার তৈরি করব। উৎপাদিত বায়োগ্যাস থেকে কী পরিমাণ এলপিজি রপান্তর করব। একই সঙ্গে দেশের কী সংখ্যক কৃষক জৈব সার পাবে। তা কৃষিতে কতখানি অর্থনৈতিক প্রাপ্তি যোগ করবে। উদ্যোগগুলো বেসরকারি খাত থেকেও নেওয়া যেতে পারে। সরকারের সহায়ক প্রকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। এমন বৃহৎ কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে তার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।
এই যে কোরবানি ঈদে আমাদের বিপুল সংখ্যক গরু ছাগল জবাই হলো। সেগুলো থেকে কী বিপুল পরিমাণ বর্জ্য বের হয়েছে। কিন্তু এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারিনি আমরা। আমরা শুধু ভেবেছি কীভাবে নিজেদের মায়লা আবর্জনা কোথায় ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হব। কিন্তু কোরবানির সব বর্জ্য যে বিশাল একটি সম্পদ, এটিও যে প্রক্রিয়াজাত হয়ে জৈবসারসহ নানান পণ্যে রূপ নিতে পারে, সেই ভাবনাটি আমরা ভাবতে পারিনি। কোরবানির সঙ্গে যুক্ত কসাই থেকে শুরু করে সবার যেমন এখানে জানা বোঝার বিষয় রয়েছে, একইভাবে রয়েছে সমন্বিত একটি উদ্যোগের মাধ্যমে কোরবানি বর্জ্য ব্যবস্থানায় আরো বহু মানুষের কর্ম সংস্থানের সুযোগ।
দেশের মানুষের ঘরে ঘরে যেসব গৃহপরিচারিকা কাজ করেন, তারা যদি জানতেন রান্নাঘরের বর্জ্য কত দামি সম্পদ তাহলে তাদেরও চোখ খুলে যেত। আমার মনে হয়, এই বোঝাপড়াটা সবারই দরকার, আমরা যা ব্যবহার করছি তা দামি, আর যা ফেলে দিচ্ছি তার দাম যে আরও বেশি এটি বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে এখন। কবি কায়কোবাদের সেই কবিতার কথা মনে পড়ছে, ‘‘যে ভুলে তোমারে ভুলে - হীরা ফেলে কাঁচ তুলে, যে ভুল করেছি আমি, আমার সে ভুল প্রভু তুমি ভেঙে দাও”।
লেখক: ড. মঈনউদ্দীন সরকার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান, ওয়েস্ট টেকনোলজিস্ট এলএলসি, ইউএসএ।
এসএন