অপ্রত্যাশিত অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে
দেশে ফের ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটল। গত ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। নিহত ও আহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সীতাকুণ্ডের বাতাস। একইসঙ্গে এমন ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা দেখে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ শোকে বিহবল।
দেশে প্রতিবছরই ঘটছে একের পর এক অনাকাঙ্খিত অগ্নি দুর্ঘটনা। আর এই অগ্নি দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। লাখ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। আগুণে পুড়ে নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ । অগ্নি দুর্ঘটনা থামবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে মোট অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২১,৬০১টি। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২১৮ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ৪০৩ টাকা।
প্রতিবেদনে অগ্নি দুর্ঘটনার অনেক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেসবের মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগকে। ওই বছর বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ৭,৯৫৫টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট অগ্নি দুর্ঘটনার ৩৬.৮২ শতাংশ। চুলা (বৈদ্যুতিক, গ্যাস এবং মাটির চুলা, ইত্যাদি) অগ্নি দুর্ঘটনার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ওই বছর মোট ৩,৯২২ টি অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ ছিল। শতকরা হিসাবে যা মোট অগ্নি দুর্ঘটনার ১৮.৫৫ শতাংশ।
অগ্নি দুর্ঘটনার তৃতীয় কারণ ছিল বিড়ি-সিগারেটের আগুন। মোট অগ্নি দুর্ঘটনার ৩,১৯৩ বা ১৪.৭৮ শতাংশ ঘটেছে এই কারণে । প্রতিবেদনে অগ্নি দুর্ঘটনার মোট ১৯টি বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এগুলো ছাড়াও অজ্ঞাত হিসাবে মোট ৩ হাজার ২৮২টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২১ সালে, অগ্নি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন মারা গিয়েছিল এবং ৫৭৬ জন আহত হয়েছিল। ওই বছরে সবচেয়ে বেশি অগ্নি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে বাড়ি বা আবাসিক ভবনে, যার সংখ্যা ছিল ৫,৮১৮টি। রান্নাঘরে ৩,৫৪৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পোশাক শিল্প ছাড়া অন্যান্য কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ৩৮২টি। প্রতিবেদনে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে।
গত বছর নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। অপর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গত ৫ বছরে দেশে প্রায় ১ লাখ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৫ বছরে সারাদেশে পুড়ে গেছে অন্তত ১২ হাজার মানুষ। আর অগ্নি দুর্ঘটনায় মারা গেছে দুই হাজারের বেশি মানুষ।
মূলত অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে প্রতি বছর অগ্নি দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ ও প্রাণি মারা যাচ্ছে ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, দাহ্য কেমিক্যালের গোডাউনে অগ্নি দুর্ঘটনা, রান্নাঘরের ত্রুটিপূর্ণ চুলা ও বিড়ি-সিগারেটের ফেলে দেয়া জ্বলন্ত অংশ থেকেই ঘটছে ছোট থেকে বড় ধরনের অগ্নি দুর্ঘটনা ।
যে কোনো অগ্নি দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং অগ্নিকাণ্ডের কারণসহ তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন সতর্কতামূলক সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এই সুপারিশ খুব কমই বাস্তবায়িত হয়।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ দফা সুপারিশ করেছিল। ওই সুপারিশমালার মধ্যে ছিল জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকান্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্য আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকান্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলো নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা ইত্যাদি। কিন্তু সেসব সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ অবহেলা। আর সেই সঙ্গে আছে অজ্ঞতা। তাই প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সচেতন হওয়া উচিত। রান্না করার পরে, চুলার আগুন সম্পূর্ণরূপে নিভিয়ে দিতে হবে। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। এ ছাড়া শিল্প ও কারখানায় ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে এবং গ্যাসের চুলা জ্বালানোর আগে নিয়মিত গ্যাস সংযোগ ও লাইন চেক করতে হবে। একজন অভিজ্ঞ ইলেক্ট্রিশিয়ান দ্বারা নিয়মিতভাবে বিল্ডিংয়ের বৈদ্যুতিক তার এবং ফিটিংগুলি পরীক্ষা করাতে হবে। প্রত্যেক বাড়ী বিশেষ করে বহুতল ভবন, শিল্প ও কলকারখানায় অগ্নি প্রতিরোধ, নির্বাপণ, উদ্ধার ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণও থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় নিয়মিত অগ্নি দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের মহড়া আয়োজন করতে হবে।
যে কোনো ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবন নির্মাণের নিয়ম বা বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি শিল্প, সরকারি ও বেসরকারি ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপক ব্যবস্থা থাকাতে হবে। সেইসঙ্গে এসব পরিচালনার নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে প্রয়োগ করতে হবে। একটি অটো-ফায়ার অ্যালার্মিং সিস্টেম থাকতে হবে যাতে আগুন লাগলে সবাইকে তাৎক্ষণিকভাবে সতর্ক করা যায়। ভবন বা কারখানার প্রতিটি তলায় একটি বহির্গমন চিহ্ন থাকতে হবে যাতে অন্ধকারেও তা দেখা যায়। অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে, ফায়ার সার্ভিসের জন্য ৯৯৯ নম্বরে কল করতে হবে।
অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে এসব দুর্ঘটনা মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আর যারা এগুলো মানবে না তাদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমাদের এই প্রিয় দেশ ও মানুষের জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। অপ্রত্যাশিত অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে।
ড. মতিউর রহমান, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী