জননেত্রীর প্রত্যাবর্তন ও আজকের বাংলাদেশ
আজ ঐতিহাসিক ১৭ মে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে শাসকদের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে, জীবনকে বাজি রেখে ৪১ বছর আগের এই দিনে তিনি যখন পিতৃভূমিতে ফিরে আসেন, এ জাতি তখন দিকশূন্য অবস্থায় অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের পথে টলায়মান। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং তার পেছনে থাকা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি আওয়ামী লীগকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করছিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তখন পাকিস্তানি ভাবাদর্শ কায়েমের মাধ্যমে উল্টো পথে চলছে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ঘাতকচক্রের হাতে সপরিবারে নিহত হবার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের রাজনীতি তখন বিভ্রান্ত ও পথহারা। সামরিক শাসকের নির্যাতন-নিগ্রহে জর্জরিত আওয়ামী লীগে তখন বিভাজন ও নেতৃত্ব-সংকট। এমনই একটি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও জাতির ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলের ইডেন হোটেলে তিন দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে সম্মতিক্রমে শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
এর আগে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজ-খবর নিতে। আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক কাবুল যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সাথে দেখা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, তৎকালীন যুবলীগ নেতা আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও দিল্লিতে যান।
শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এম ওয়াজেদ মিয়া এ বিষয়ে লিখেছেন, তাদের সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো।
১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের শীর্ষ নেতারা দিল্লি যান। সেখানে কয়েকটি বৈঠকও করেন তারা। এরপর জননেত্রী শেখ হাসিনার ঢাকা ফেরার তারিখ চূড়ান্ত হয়। ১৬ মে শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকেলে কোলকাতা থেকে তিনি ঢাকায় ফেরেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। (তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ; এম এ ওয়াজেদ মিয়া)
সেদিন ছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে জনতার ঢল নেমেছিল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা। এছাড়া ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব, বলেও স্লোগান দেওয়া হয়। জননেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বরণ করে নিতে মানিক মিয়া এভিনিউতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনতার ঢল নামে।
উপস্থিত জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুতনয়া সেদিন উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি সব হারিয়ে আজ আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি শুধু আমার পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। প্রয়োজনে আমার পিতার মতো জীবন দেব, তবুও আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আপস করবো না।’ সেদিন থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ক্লান্তিহীনভাবে তিনি বাংলার মানুষকে সাথে নিয়ে অকুতোভয় চিত্তে সংগ্রামে নেমেছেন। দীর্ঘ ৪১ বছরে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য অবিকল্প রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে লড়াই করে আসছে। সে লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন বলেছিলেন, ‘আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ সেদিনের পর থেকে তিনি ক্লান্তিহীনভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে এদেশের মানুষের জন্য নিবেদন করেছেন।
দেশে তখন জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলছিল। এর মাঝে শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরা ছিল একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করা হয়। এমনকি ১৯৮১ সালে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি’ পর্যন্ত করানো হয়েছিল। নানা হুমকি-ধামকি, লিফলেট বিতরণ ও নানা অপপ্রচার চালিয়ে মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টাও তারা কম করেনি। তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সমস্ত ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরেছিলেন। এদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সমর্থন তাঁকে সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করার সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিল।
যার শরীরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্ত বহমান, তার তো লড়াইয়ের মাঠে ভয় পেলে চলবে না। তিনি তো জানতেন এই বাংলার মানুষের প্রতি পিতার আবেগ ও ভালোবাসা ছিল কতটা গভীর। তিনি তো জানতেন এই বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি কী গভীর ভালোবাসা লালন করে। তিনি ফিরে এসেছেন, এই বাংলার আপামর দুখি মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার দুর্নিবার স্বপ্ন নিয়ে-- যে মানুষেরা জাতির পিতার ডাকে তাদের জীবন বাজি রেখে অকুতোভয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তিনি ফিরে এসেছেন পিতার নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীনতা ও পতাকার মর্যাদা রক্ষার সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।
বাংলার মানুষের উদ্দেশ্যে আজও তিনি একটা কথা প্রায়ই বলেন— 'আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, শিশু ছোটভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।' তাঁর এ কথা শুধু কথার কথা নয়। এটি তাঁর কোন রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। এর প্রমাণ তিনি দিয়ে যাচ্ছেন দিন-রাত এক করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এদেশের মানুষের জন্য তাঁর আত্মনিবেদনের মাধ্যমে। ৭৫ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের যত অর্জন, এর সবকিছুই তাঁর নেতৃত্বে তাঁরই শাসনামলে। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ তো বটেই, সবচে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রথম কাতারে। উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে স্বীকৃত। তার সুপরিকল্পিত, দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই আমাদের আজকের এই অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রেও দেশবিরোধী শক্তির নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মাসেতু আজ বাংলাদেশের সামর্থ্য ও সক্ষমতার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। এই সেতু খুলে দেয়ার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের চিত্রটি পাল্টে গিয়ে অর্থনীতিতেও অনেক গতি সঞ্চার হবে। শুধু পদ্মাসেতুই দেশের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ককে ৬ লেনে রূপান্তর করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। মেট্রোরেল, উড়ালসেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে।
বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষিখাতে পর্যাপ্ত ভূর্তকি প্রদান, কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার ও উন্নত বীজ সরবরাহ ও বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের মাধ্যমে আমাদের ফসল উৎপাদন এখন পর্যাপ্ত। তাঁর গৃহীত উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ বর্তমানে ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যা শিল্পখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে ভূমিকা রাখবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো ও বিদ্যুৎব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান আছে। যা শিল্পখাতে বিপ্লবসাধনের পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই এদেশে কুখ্যাত বিচারকার্য সম্ভব হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর সুযোগ নেতৃত্বের কারণেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, গঙ্গার পানিচুক্তি, ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান জননেত্রী শেখ হাসিনার গৌরবময় অর্জন। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে অনুকরণীয়, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধ করে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মানের পথে তিনি অপ্রতিরোধ্য রাষ্ট্রনায়ক। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ প্রায় অর্ধশত বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় বাজেটের আকার বাড়তে বাড়তে এখন ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
আজকের বাংলাদেশের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তার দেয়া রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, ইনশাল্লাহ। দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মমতা, তাঁর সততা ও কর্মদক্ষতা তাঁকে বর্তমান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতার আসনে আসীন করেছে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রত্যাবর্তন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনার। তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছিল বাংলার মানুষের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। তিনি প্রায়শই বলে থাকেন, আমি প্রধানমন্ত্রী নই, আমি বঙ্গবন্ধু-কন্যা। তাঁর এ কথার সাথে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি দেশশাসন করেন না, আন্তরিক মমতায় দেশ পরিচালনা করেন। তাইতো এদেশের অগণিত নেতাকর্মীর কাছে তিনি তাদের প্রিয় আপা।
৭৫-এর পর বিগত ৪৭ বছরে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দেশে ফেরার পর ১৯ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি মৃত্যুর হাত বেঁচে ফিরেছেন বাংলার মানুষের দোয়া ও মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের জন্য। তিনিই বাংলাদেশ।
আমি আমাদের প্রিয় আপা বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুস্থ ও দীর্ঘজীবনের জন্য প্রার্থনা করছি।
লেখক: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আরএ